প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ৩
ড. তুহিন ওয়াদুদ
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১১:০৩ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১২:০৬ পিএম
ড. তুহিন ওয়াদুদ
দেশ স্বাধীন হওয়ার
পর থেকে পিছিয়ে পড়া বিভাগের নাম ছিল রাজশাহী। রাজশাহীতে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলো ছিল বর্তমান
রংপুর বিভাগে। ফলে যখন রংপুর নামে বিভাগ সরকার ঘোষণা করল তখন দেশের সবচয়ে বেশি গরিব
বিভাগের অভিধা পেল রংপুর। কেবল তাই নয়, ২০১১ সালের দারিদ্র্য মানচিত্র এবং ২০১৬ সালের
দারিদ্র্য মানচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দেশের সবচেয়ে গরিব ১০ জেলার পাঁচটি রংপুর
বিভাগে। এ দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। বিভাগ বিবেচনা
ছেড়ে দিলে জেলা পর্যায়ে সারা দেশের মধ্যে প্রায় প্রতি বছর দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকে
কুড়িগ্রাম। এ বৈষম্য সব সময়ই ভয়াবহ পর্যায়ের। যেমন ২০১১ সালের দারিদ্র্য মানচিত্রে
দেখা যায় কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৬৩ শতাংশ আর কুষ্টিয়ায় মাত্র ৩ শতাংশ। ২০১৬
সালে নারায়ণগঞ্জে দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশের নিচে আর রংপুরে ৭০ শতাংশের ওপরে। উপজেলা
পর্যায়ে এ পার্থক্য ২০০ গুণ ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে ওই সময়ে। কুড়িগ্রামের রাজিবপুর
উপজেলার সঙ্গে ঢাকার গুলশানের পার্থক্য এমনই।
সঠিক পরিকল্পনা নিলে রংপুরের দুঃখ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তিস্তা নদীই দেখাতে পারে সমৃদ্ধির ঠিকানা। ছবি : আহসানুল হক সুমন
২০১১ সালের দারিদ্র্য
মানচিত্রে সারা দেশে গড় দারিদ্র্য ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০১৬ সালে এ দারিদ্র্য গড়ে কমেছে
প্রায় ৭ শতাংশ। কুড়িগ্রামে দেখা গেছে বেড়েছে ৭ শতাংশ। রংপুর বিভাগেও দারিদ্র্য বেড়েছিল
অনেক। সারা দেশে যখন দারিদ্র্য কমেছে তখনও রংপুরে দারিদ্র্য বেড়েছে। অথচ রংপুর বাংলাদেশের
কৃষি অর্থনীতিতে অভাবনীয় ভূমিকা পালন করে চলছে। রংপুর বিভাগে যে খাদ্যশস্য উৎপাদিত
হয় তা এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদার দ্বিগুণের বেশি। তার পরও দেখা যায় খাদ্যসংকটে থাকে
রংপুর বিভাগের মানুষ। এর প্রধানতম কারণ দেশে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি না থাকা।
আমাদের দেশে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তা ছিল বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে। ৩০ লাখ মানুষের
প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন
ছিল। এ বৈষম্য রোধ কেবল বিভাগের সঙ্গে বিভাগের নয়, জেলার সঙ্গে জেলার নয় বরং উচ্চশ্রেণির
সঙ্গে বিত্তহীনের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য যে এ বৈষম্য রোধে কোনো সরকারের বিশেষ কোনো
কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি। বরং এমনসব কাজ করেছে যাতে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
রংপুরের উন্নয়নে
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট। রংপুর বিভাগে যারা নেতা আছেন তারা
নিজ বিভাগের সমস্যা যেমন হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন তেমন উন্নয়ন হতে পারে এমন সব কার্যক্রম
বাস্তবায়নেও সরকারকে কার্যকর করতে পারেননি। প্রতি বছর যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ
করা হয় তাতে রংপুর বিভাগের অংশীদারি থাকে না বললেই চলে। এমনও হয়েছে, দেশের কোনো একটি
জেলার জন্য মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশ আর রংপুর বিভাগের জন্য ১ শতাংশের কম অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।
রংপুরের উন্নয়নের
বহু পথ রয়েছে। রংপুর অঞ্চলে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে এখানে বেকারত্ব কমে
আসত। এর জন্য দুটি কাজ করা প্রয়োজন। প্রথমত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুত হয় এ ব্যবস্থা
করা। আকাশপথে সৈয়দপুর বিমানবন্দর হয়ে এলে সময় কম লাগে। কিন্তু কুড়িগ্রামের চিলমারী
অথবা গাইবান্ধা থেকে ব্রহ্মপুত্রের ওপর টানেল কিংবা সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে রংপরের দূরত্ব
অনেকটাই কমে আসত। পাঁচ-ছয় ঘণ্টায় ঢাকা-রংপুর যাতায়াত করা যেত। এ পথে রেলÑসড়ক দুই খোলা থাকত। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা-মেঘনার
পথে সারা দেশ তথা বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। বিশেষ করে অপচনশীল মালামাল বহন
করা যেত।
রংপুরে শিল্পকারখানা
সম্ভব নয় কিংবা লোকসান হবে এমন ধারণা ভেঙে দিয়েছে এখনকার বেশ কিছু কারখানা। আজ যে প্রাণ-আরএফএলের
বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য তার গোড়াপত্তন হয়েছে রংপুরে। কারুপণ্য নামের প্রতিষ্ঠানটির পরিধি
যে বৈশ্বিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তারও মূলের সঙ্গে রংপুর জড়িয়ে আছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে
দীর্ঘকাল ধরে অনেক শিল্পকারখানা চলছে। উত্তরা ইপিজেডও ভালোভাবে চলমান আছে। এসব কিছুতে
একটি বিষয় পরিষ্কার; ব্যবসায়ীদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস দেওয়া গেলে কারখানার সম্প্রসারণ
সম্ভব। প্রয়োজনে শুরুতে ব্যবসায়ীদের রংপুরমুখী করতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার প্রণোদান
দিতে পারে। কৃষিনির্ভর বাণিজ্যকেন্দ্র এখানে গড়ে উঠতে পারে। ভারতের সেভন সিস্টার্স
খ্যাত সাত রাজ্যে বাংলাদেশ ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও বাড়াতে পারে। তিস্তা নদী দিয়ে সিকিম
থেকে পশ্চিমবঙ্গের পূর্বপ্রান্ত আসাম-মেঘালয়সহ পাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে জলপথ সহজ করে
তোলা সম্ভব।
রংপুর বিভাগে
রেমিট্যান্সের অবস্থা খুবই নিম্নগামী। সারা দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম জনশক্তি বিদেশে
যায়। এর অন্যতম কারণ বিদেশে যাওয়ার জন্য যে টাকা এবং যোগাযোগ প্রয়োজন হয় এর কোনোটি
রংপুরের মানুষের কাছে নেই। রংপুর অঞ্চলের রেমিট্যান্স অনেকটা বিভিন্ন জেলায় কিংবা রাজধানীতে
গিয়ে রিকশাওয়ালা কিংবা পোশাক শ্রমিকের পাঠানো টাকা। সরকারিভাবে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
করে রংপুর বিভাগের জনশক্তিকে বিশেষ ঋণ প্রদান সাপেক্ষে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা
গেলে অনেক পরিবারের অর্থনীতির চাকা সচল হতো।
রংপুর বিভাগের
নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে ব্যাপক নদী ভাঙন হয়। কোনো পরিচর্যা
না থাকায় নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। সেজন্য সামান্য বৃষ্টির পানিতে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ
বন্যা। এ ক্ষেত্রে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-ধরলা-দুধকুমার-গঙ্গাধর-গদাধর নদ-নদী উল্লেখযোগ্য।
প্রতি বছর এসব নদ-নদীর ভাঙনে আর বন্যায় যে ক্ষতি হয় তার অর্থমূল্য কোনোভাবে ১ লাখ কোটি
টাকার কম নয়। অর্ধলক্ষাধিক মানুষ প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত হয়। এসব মানুষ এ অঞ্চলের দারিদ্র্যসূচক
আরও বাড়িয়ে তোলে। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নদীর পরিচর্যা করা প্রয়োজন। নদীর ভাঙন
আর বন্যা রোধে সরকারকে যে টাকা ব্যয় করতে হবে তা অন্তত এক মৌসুমের ক্ষতির পাঁচ ভাগের
এক ভাগের কম হবে।
সারা দেশে অনেক
মেগা প্রকল্প চলমান। রংপুর বিভাগে সে রকম কিছু নেই। এ বিভাগের জন্য নদী ভাঙন রোধ এবং
নদী ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করা গেলে যেকোনো মেগা প্রকেল্পর চেয়ে লাভজনক হতো।
তিস্তায় একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে আট বছর ধরে। যখন কথা উঠেছিল
তখন শোনা গেছে মাত্র সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সুরক্ষা সম্ভব। ২০২৩ সালে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের জনসভায় এক বক্তৃতায় তিস্তা মহাপরিকল্পনার
কথা বলেছেন। ২০১৬ সালে তারই শাসনামলে সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তিনি আবারও ঘোষণা দিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
বার্ষিক উন্নয়ন
কর্মসূচিতে সরকারের বরাদ্দ সীমাহীন বৈষম্যমূলক। এ বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ উদ্যোগ সরকারকেই
গ্রহণ করতে হবে। রংপুরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের জন্য ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে ব্যবস্থা
করতে হবে। শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রেমিট্যান্স যাতে রংপুরের জনগণও উপার্জন
করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। রংপুর থেকে সারা দুনিয়ার জলপথ চালু করতে হবে।
রংপুর দারুণ সম্ভাবনাময়
অঞ্চল। এখানে মানুষের সারল্য আর যাপিত জীবন সুখের অনুকূলে। এখানকার মানুষের জীবনে অর্থনীতির
চাকা সচল হলে দারিদ্র্যতিলক মুছে যাবে। যে লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সেই চেতনার
পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। এমনকি সংবিধান যে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে বিশেষ নির্দেশনা
জারি রেখেছে, সেই নির্দেশনারও প্রতিপালন হবে।