প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ২
যতীন সরকার
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪ ১২:৪৮ পিএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ০০:০৮ এএম
যতীন সরকার
আগামী দিনের সম্ভাবনার
স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে আমাদের
পরাধীনতার কঠোর বাস্তবতার শুরু। উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়েও এই কঠোর বাস্তবতা থেকে আমরা
মুক্তি পাইনি। ব্রিটিশ শাসনের গ্লানি থেকে মুক্তির পর আবারও আটকে পড়ি পাকিস্তানে। হাজার
বছর ধরে বাঙালির যে সংস্কৃতি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরার প্রয়াস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি
শাসকদের মধ্যে। তবে সংস্কৃতি তো মরে না। সংস্কৃতি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। এই রূপান্তর
ইতিবাচক। রূপান্তরের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকে, থাকে স্বাধিকার চেতনার ভাবনা। ব্রিটিশ
উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়েও আমাদের বঞ্চনা-লাঞ্ছনার ইতিহাস শেষ হয়নি। কিন্তু নিজের সংস্কৃতি
ও তার ইতিবাচক রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে ছিল এবং আমরা গড়ে তুলেছিলাম প্রবল
সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।
স্বাধীনতার অব্যবহিত
পর আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অপদর্শনের
অবসান ঘটবে। কিন্তু বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি, পাকিস্তান মরে গিয়েও আমাদের ওপর যেন ভূত
হয়ে চেপে বসে ছিল। গ্রাম-বাংলায় একটি কথা রয়েছে, মানুষ মরে ভূত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রও
যে মরে ভূত হতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করেছি পঁচাত্তরে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে
তাঁরই নেতৃত্ব ও ডাকে স্বাধীনতা অর্জনকারী জাতি অসাম্প্রদায়িক দেশে স্বাধীনতার চেতনার
বিসর্জন দেখাল কতিপয় স্বজাতদ্রোহীর অবিমৃশ্যকারিতায়। যে অপদর্শন আমাদের বঞ্চনা-লাঞ্ছনার
ইতিহাসে আটকে রেখেছিল তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে শুরু করেন পাকিস্তানপন্থি
উগ্রবাদীরা। পাকিস্তানের মিত্রশক্তির কাছে নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেতে
শুরু করে বাংলাদেশ। পাকিস্তান মরে গিয়েছিল সত্য, কিন্তু ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে। খন্দকার
মোশতাকের ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের খোলসে পাকিস্তানি শাঁস পুরে দেওয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন
অব্যাহত ছিল। কিন্তু মানুষের তো প্রত্যাশা ফুরোয় না।
মানুষ আরও প্রত্যাশা
করে। বারবার স্বপ্নভঙ্গের মাঝেও এ প্রত্যাশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের
প্রতিটি ক্ষণে আমিও প্রত্যাশা করেছি। বাঁচিয়ে রেখেছি নিজের মনোলোকে ইতিবাচকতার সুপ্ত
প্রত্যাশা। আগামী বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার অনুসারে
অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ঘিরে স্বপ্নের তো শেষ
নেই। স্বপ্ন ও গড়ার নতুন প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্ব যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের
সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল এর পথ ধরে এগোতে গিয়ে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হলো পঁচাত্তরে।
দীর্ঘদিন অপশাসনে জর্জরিত দেশ-জাতি এক পর্যায়ে মুক্তি পেল, শুরু আবার নতুন করে পথচলা।
এখানেও স্বপ্নই উপজীব্য।
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র,
গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাÑ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলে ছিল এই
চারনীতি। এই চার মূলনীতি আমাদের জাতীয়তাবোধের সুতোয় গেঁথে গড়েছিল অপদর্শনের বিরুদ্ধে
সোচ্চার মালা। স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন সময় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ নিয়ে নানা মুনির
নানা মত দেখা গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গটি স্বাধীন দেশে বরাবরই আলোচনার বড় প্রসঙ্গ।
এ বিষয়ে বিভিন্নজন স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। সরল এই প্রসঙ্গ নিয়ে এত বিশ্লেষণ
হয়েছে যে, এ নিয়ে নতুন করে এখন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেরও যেন কিছু খুঁজে পাই না। শব্দটির
ধারণা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনকারী শক্তির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা
রয়েছে টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে। তারপরও ধর্মনিরপেক্ষ এবং পরমতসহিষ্ণু রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা জিইয়ে রয়েছে। আমরা দেখছি, একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম
আখ্যা দেওয়া হয়। আবার একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। একই সঙ্গে পরস্পর
সাংঘর্ষিক এমন বক্তব্যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বোঝায় বা এর উত্তর কী? তারপরও
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবিক রূপ
দিতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির অর্থাৎ প্রগতিশীল সব শক্তির ঐক্যের বিকল্প নেই।
জাতীয়তাবোধের অভাবহেতু জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ আজও বৈষম্যের সাগরে যেন হাবুডুবু
খেয়ে চলেছে। যদি আমরা বৈষম্যের নিরসন করতে চাই, তাহলে এ চার মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্র
পরিচালনা করতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উপেক্ষা করে।
এমনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের মূল চেতনার বিষয়ে আমাদের এ দ্বিধা দূর
করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ধারণ করেই এগোতে হবে।
অর্জন-অনর্জন,
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, গ্লানি নিয়েও কথা কম হয়নি। এ পূর্বস্মৃতি আমরা যেন ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি, সেজন্যই জাতীয় ইতিহাসের স্মরণে কিছু দিবস আমরা পালন
করি। কিছু দিবস পালন করি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য। যেকোনো জাতি বা
দেশ অনেক সময় কৃত্রিম ধারণামাত্র। তবে কৃত্রিম বিভাজনকে স্বতন্ত্র পরিচয় দেয় জাতিগত
আদর্শ ও একতা। জাতীয়তাবোধ আদর্শ ও একতা গড়ে তোলে। জাতি যদি উল্টোপথে হাঁটা শুরু করে,
তাহলে সাংস্কৃতিক একাত্মতার মাধ্যমে আবার সঠিক পথে ফিরে আসা সম্ভব, যদি দূরদর্শী নেতৃত্বের
হাতে দেশ পরিচালিত হয়। বিগত বাহাত্তর বছর অতিক্রান্তে আজ আমরা উন্নয়ন-অগ্রগতির চওড়া
সড়কে রয়েছি বটে, কিন্তু এখনও অনেক কিছু অর্জনের বাকি আছে। জাতি হিসেবে আমাদের আত্মসচেতনতার
অভাব রয়েছে, এ সত্য অস্বীকার করা যাবে না। এ অভাব দীর্ঘদিনেও পূরণ হয়নি। অথচ এমনটি
হওয়ার কথা ছিল না। বাঙালির চেতনাবোধ ও নিজ অধিকার সম্পর্কে আত্মসচেতনতাই আমাদের পাকিস্তানের
ভূত তাড়াতে সহযোগিতা করেছিল এবং তা-ই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্ব আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তনের স্বর্ণোজ্জ্বল
অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শুধু একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি ও পতাকাই দেয়নি, এর মাধ্যমে
অর্জিত বাংলাদেশ আজ নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বিশ্বে। মুক্তিযুদ্ধের যে প্রত্যয় ও অঙ্গীকার
ছিল, এর পূর্ণতা এখনও সর্বাংশে মেলেনি বটে, তবে রক্তস্নাত বাংলাদেশ ঘিরে প্রত্যাশা
এখনও গগনমুখী। অবকাঠামো ও অর্থনীতির নানা খাতে হয়েছে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন। আজ বাংলাদেশকে
দুর্বল রাষ্ট্র কেউ বলতে পারে না। স্বাধীনতা আমাদের কত কিছু দিয়েছে তার প্রমাণ স্পষ্ট
দৃশ্যমান। শুধু কিছু লোক তা এখনও ঠাওর করতে পারছে না। এই ঠাওর করতে না পারা তাদের ব্যর্থতার
দিকটিই স্পষ্ট করে দেয়। তবে স্বাধীনতার পর আমরা ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়েছি ভেবে তৃপ্ত
হয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। বায়ান্ন বছরে আমরা কী পেলাম আর কী পেলাম না, তার হিসাব করা
জরুরি।
বর্তমান বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে আশঙ্কা জাগে তরুণ প্রজন্ম নিয়ে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ,
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ- এসবই প্রত্যাশার দিগন্তজুড়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এক্ষেত্রে
আমাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। নতুন প্রজন্মকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আত্মসচেতনতার
দিক সম্পর্কে সচেতন করে তোলা আগামীর স্বার্থেই জরুরি। স্বাধীন দেশে তরুণ প্রজন্ম নেতৃত্বের
দায়িত্ব নেবে- তা অন্যতম প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণের জন্যই দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছি।
অনেক শিক্ষার্থীকে শিখিয়েছি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে। দেশ, জাতি, আদর্শ ও বিজয়ের মূল্যবোধ
তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি সবসময়। বিগত চার দশকে সাক্ষরতার হার বেড়েছে।
বেড়েছে শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। কিন্তু স্বাধীনতার মূল্যবোধ দ্বারা চালিত তরুণ প্রজন্মের
অভাব ভীষণভাবে বোধ করি। তবে আগামীর সমূহ সম্ভাবনার প্রত্যাশায় আজও প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে
তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার
জন্য বিপুলসংখ্যক নির্মোহ রাজনীতিকের প্রয়োজন। রাজনীতিক গড়ার বর্তমানের নতুন এই তাগিদ
অগ্রাহ্য করি কী করে?
প্রাপ্তির সঙ্গে
অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে হয়। না হলে জাতি হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের দায়মোচনের
সুযোগ হিসাব করা যায় না। এ কথা সত্য, স্বাধীনতার পর আমাদের উন্নয়নের সড়কটা বড্ড একরৈখিকভাবে
এগিয়েছে। নদীর মতো এঁকেবেঁকে সর্পিল গতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারেনি মানুষের জীবনে।
মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে- এ কথা যেমন সত্য তেমনি এ-ও সত্য, বৈষম্যের পারদ হয়েছে
এবং হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী। দুর্নীতিবাজ ও বলবানদের আরও চাওয়া ও পাওয়ার নানা কসরত কদর্যতার
ছায়া বিস্তৃত করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যেকের সমানাধিকারের স্বপ্ন দেখেছি আমরা।
কিন্তু বৈষম্য আজও দূর হয়নি, বরং বেড়েছে। একরৈখিক বৈষম্যের ছায়ার গ্রাসে নিমজ্জিত মানুষের
মধ্যে সৃজনের আনন্দ কিংবা স্বাধীনতার আহ্লাদ আজ তেমনভাবে দেখতে পাই না। এমনটি জাতির
জন্য হিতকর নয়। আগামীর বাংলাদেশের সম্ভাবনার স্বার্থে তরুণ প্রজন্মের দিকে বাড়তি মনোযোগ
চাই। তরুণ প্রজন্মই জাতিগত আত্মসচেতনতা জিইয়ে রাখতে পারে। প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষা ও
নেতৃত্বের যে সুকুমার কলা বিকশিত হওয়া জরুরি, তা কীভাবে জাগিয়ে তোলা যায়Ñ এ ব্যাপারে
আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে।
সম্পদের সুষম
বণ্টন, অধিকারের সমতল জমিন, সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করতে দরকার রাজনৈতিক স্বচ্ছতা,
দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য বাড়াতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে
শক্তিশালীকরণের মধ্য দিয়ে। ব্যবস্থা প্রশ্নমুক্ত করতে পারলে অবস্থা ভালো হবেই। যত বড়
অশুভশক্তি বা ভূতই চেপে বসুক তরুণ প্রজন্মই মুক্ত করবে এর বলয় থেকে। শেষ পর্যন্ত আশাবাদী
থাকতে চাই। আগামীর স্বার্থে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের রূপান্তরের আশা জাগিয়ে রাখতে চাই।
বাংলাদেশ হার মানবে না। জয়ের স্মারক এঁকেছে বাংলাদেশ পর্বে পর্বে। জয় হোক মানবতার।