প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ২
নাসির উদ্দীন ইউসুফ
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪ ১২:৪১ পিএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ০০:০৭ এএম
নাসির উদ্দীন ইউসুফ
সবে একুশে পা
দিয়েছি। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে একুশ হয়েছিলাম। একুশ বছর বয়সে বিদ্রোহের
বয়সের অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তখন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক
সব স্তরে যে রূপান্তর ঘটছিল তার পেছনে ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অনেক। প্রাথমিক
পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রূপান্তরের আন্দোলনে নানাভাবে জড়িয়ে
পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশে দুটো বড় আন্দোলন চলছিল। একটি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক
আন্দোলন। ওই আন্দোলন প্রতি ঘরে ঘরে। প্রতি মহল্লায়। গানের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। গান গাওয়া
হচ্ছে। কবিতার খুব একটা তখন চল ছিল না। নাচটা ছিল। আর বছরের শেষে নাটক। ‘আমার ভাইয়ের
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলেতি পারি’- গানটা আমার বয়সি অনেককে ভীষণ প্রভাবিত
করেছিল। রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে
উঠেছেন এবং উঠেন। স্বাধীনতার আগে সংগীত ও নৃত্যের ধারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ
ঘটায়। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সাংস্কৃতিক নবজাগরণের প্রাণোচ্ছলতা
ভালোভাবেই উপলব্ধি করছিলাম। রূপান্তরের এই ধারা পরিণতি লাভ করে ষাটের দশকে। পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার পর তা আরও বেশি বেগবান হয়। এভাবেই সংস্কৃতি
আর রাজনীতির যোগসূত্র স্থাপিত হয়। পাকিস্তানি শাসকরা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে সংস্কৃতিচর্চার
পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী
তখন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। তারা সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব ভালোভাবেই উপলব্ধি
করেছিলেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাই সংস্কৃতির রাজনৈতিক গুরুত্বও সৃষ্টি হলো।
এভাবেই বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের নবযাত্রা শুরু। তখন স্লোগান আর গান একীভূত হয়ে পড়ে।
সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যেই আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠছিল।
ট্যাপেস্ট্রি : রশিদ চৌধুরী
সত্তরের দশকে
এরই মধ্যে শুরু হলো শিক্ষা আন্দোলন। আমি মনে করি, বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এই
আন্দোলনটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সভা ও বক্তৃতায় কবিতা আবৃত্তি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে
দাঁড়িয়েছিল। এক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহই বেশি দেখা
যেত। আমরা পল্টন ময়দানে অথবা মতিঝিলের কোনায় দাঁড়িয়ে তাদের বক্তৃতা শুনেছি। ট্রাকের
ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন। প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। একষট্টিতে রবীন্দ্রনাথের গান জন্মশতবার্ষিকী
নিষিদ্ধকরণ, বাষট্টিতে শিক্ষা আন্দোলন, চোষট্টিতে নির্বাচনে কারচুপি, ইত্যাদি একের
পর এক কত যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা! তখন বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। এসব মিলে
ছয় দফা আন্দোলন। তখন প্রজন্ম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে
সংস্কৃতি ও রাজনীতির পাঠ পেয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে তরুণরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল
মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্বে।
স্বাধীনতার আগে
সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা আমাদের জাতীয়তাবাদের দিকে ধাবিত করেছে। স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তখন আমরা
আর পাকিস্তানের অংশ নই। ‘স্বদেশে’ ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ
ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের ওপর নির্ভর করে পেয়েছি সংবিধান। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র,
সমাজতন্ত্র, সম-অধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তখন বলেছিলেন। স্বাধীন দেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর
পূর্বপরিকল্পনা ছিল। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের ওপর অনেক অত্যাচার
হয়েছে। পাকিস্তানের ২৩ বছর আপনারা অনেক নিপীড়িত হয়েছেন। বাংলাদেশ কোনো একক ধর্মের দেশ
নয়। বাংলাদেশ সকল ধর্মের দেশ।’ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ঘোষণা
দেওয়া জরুরি ছিল। কারণ আমরা দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পরীক্ষিত হয়ে যাওয়ার আগেই
আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। তা তিনি বলার চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাষায়
নিজেকে প্রথমে বাঙালি পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক ধারণার ধারাবাহিকতার
কথা তিনি ভোলেননি।
স্বাধীনতার পর
নব-উদ্যমে শুরু করি নাট্যচর্চা। সংস্কৃতির বিকাশ, প্রচার ও প্রসার নিয়ে আমাদের আগ্রহের
কমতি ছিল না। সাধারণ মানুষও সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। নাটক, শিল্প-সাহিত্যের
আবেদন তখন জনতার আশার আলো দেখিয়েছিল। চুহাত্তর সালে নাটকের অনেক ভিড় ছিল। দেশে তখন
দুর্ভিক্ষ। তখনকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি নিয়ে আমরা নাটক করেছি।
আশির দশকে সামরিক শাসনকালে সংস্কৃতিচর্চার পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল। আমরা প্রথম একটা রাস্তার
নাটক শুরু করি। সংস্কৃতিচর্চার পথ তরুণ প্রজন্ম রুখে দিতে দেয়নি। কিন্তু স্বাধীন দেশে
সংস্কৃতিচর্চার পথে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের
পর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের পর ধর্মীয় পরিচয়কে ঠাঁই দিয়েছেন। কিন্তু পঁচাত্তরে
মর্মন্তুদতার পর দেশ যাত্রা করে উল্টো দিকে। স্বাধীনতার পর প্রত্যাশা ছিল মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় পরিচালিত হবে দেশ। চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধকে ঠাঁই দেওয়া হবে সর্বাগ্রে। কিন্তু
রাজনৈতিক বাঁকবদলে ধর্মান্ধতা ও সামাজিক বৈষম্য যেন জাঁকিয়ে বসেছে। সংগত কারণেই বাহাত্তরের
সংবিধানের কাছে ফেরত যেতে চাই। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা সামাজিক ন্যায়বিচার
এবং জাতীয়তাবাদ চাই। আগে জাতীয়তাবাদ ছিল শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের
সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যে জাতিসত্তা এবং ক্ষুদ্র জাতিগুলো আছে, তাদের অধিকারগুলোও সংরক্ষিত
থাকতে হবে। স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর দেশটা সব জাতির সব বর্ণের সব মানুষের। এই প্রেরণাই
আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে পেয়েছি।
স্বাধীনতার পর
তরুণ প্রজন্মকে নিয়েও আমাদের ভাবতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে
মনে হচ্ছে, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ভেতর দিয়ে তরুণ প্রজন্মের যে ধরনের মানসিকতা গড়ে
উঠছে, সেখানে বিজ্ঞান বড় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বায়নের যুগে তথ্যপ্রযুক্তির বড় অবদান
রয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক সংকট ও সামাজিক বৈষম্যের ফলে তরুণ প্রজন্ম হতাশাগ্রস্তও হয়ে
পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচকতা রোধে সাংস্কৃতিক জাগরণ অত্যাবশ্যকীয়। স্বাধীনতার
আগে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যোগসূত্র যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তা থেকে আমরা যেন ক্রমেই
বিচ্যুত হয়ে পড়ছি। এর দায় রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা এড়াতে পারেন না। আমরা দেখছি,
দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট প্রবল। বেশির ভাগ দলেই যোগ্য নেতৃত্বের অভাবও
রয়েছে। আমাদের তেমন রাজনীতিকের অভাব রয়েছে যার আকাঙ্ক্ষা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে
একটি উন্নত রূপ প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা দেখছি, জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ
কি ধর্মভিত্তিক হবে নাকি গোষ্ঠীভিত্তিক হবে, এ নিয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে।
রাজনৈতিক দলের মধ্যকার আস্থা গড়ে তোলা জাতীয় স্বার্থেই জরুরি।
আমরা এও দেখছি,
সামাজিক বৈষম্য প্রবল আকার ধারণ করেছে। মেধা ও দক্ষতার অবমূল্যায়নের ফলে বাড়ছে বেকারত্ব।
জীবন-জীবিকার স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি না হওয়ায় শিল্প-সাহিত্যে মেধাবিকাশের সুযোগ কমছে। এক্ষেত্রে
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করতেই হয়। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রান্তেও সর্বস্তরে
বাংলা ভাষার প্রচলন করা যায়নি। বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় বাড়ছে
নানামুখী সংকট। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি পুরো ব্যবস্থাকে
আরও মানবিক করে তোলা জরুরি। বিশেষত বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষা কাঠামো পরিচালিত হলে বৈষম্য
দূর করা সম্ভব নয়। আমাদের প্রয়োজন এমন শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে মানুষকে প্রগতিশীল চিন্তা
করার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে। শিক্ষাক্রমে যদি মানবিক বিষয়গুলো
সাবলীল ও প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন না করা হয় তাহলে তরুণ প্রজন্ম শিক্ষার আলোয় আলোকিত
হবে কীভাবে? আমরা প্রায়শই নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলি। নারী পুরুষের সম-অধিকার
যদি না থাকে, নারীর ভূমিকা সম্পর্কে যদি সম্যক জ্ঞান একটা পুরুষকে না দেওয়া হয় কিংবা
পুরুষের ভূমিকার জ্ঞান যদি নারীকে না দেওয়া হয়, তাহলে বৈষম্য দূর করা কঠিনই বটে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা
ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রচার-প্রসারে সাংস্কৃতিক-সামাজিক জাগরণ একান্তই জরুরি। এক্ষেত্রে
আমাদের গোড়া থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে। কূপমণ্ডূকতার বৃত্তবন্দি না থেকে ফিরে যেতে
হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক জাগরণের তাগিদ
বারবার আসছে। তারুণ্য আমাদের ভরসা ও শক্তি। তাদের চালিত করতে হবে সৃজনের পথে।