প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ২
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪ ১২:৩৬ পিএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ০০:০৭ এএম
ড. ফরিদুল আলম
স্বাধীন বাংলাদেশ
রাষ্ট্রটি ৫২ বছর পেরিয়ে ৫৩ বছরে পদার্পণ করেছে। এ সময়ে এসে আমরা যে বাংলাদেশকে দেখছি,
সেই বাংলাদেশ গোটা বিশ্বের কাছে এক সমীহ জাগানিয়া অবস্থানে অবস্থান করছে। অথচ স্বাধীনতার
সময় থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমাদের যাত্রাপথ কণ্টকমুক্ত ছিল না। ১৯৭৫-এ মর্মান্তিক
অধ্যায় পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন, সৈরশাসন, সর্বোপরি স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালনÑসবকিছুই
একটা বড় সময় ধরে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। একটা সময় দেশের
উন্নয়নে যেখানে ছোট কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি সাহায্যের বিকল্প ছিল না এবং সুযোগ
বুঝে আমাদের রাজনীতিতে ও সরকারব্যবস্থায় বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ছিল খুবই সাধারণ বিষয়,
সময়ের পরিক্রমায় আজ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে উন্নয়নশীল তকমা পেয়েছে।
আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম
করে আজ আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছার দুর্বার গতিতে
ছুটে চলেছি। কভিড-১৯ মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের হামাস-ইসরায়েল সংঘাতসহ
নানা ঘটনায় যেখানে বিশ্বরাজনীতি এবং অর্থনীতি জর্জরিত, উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিও রীতিমতো
ধুঁকছে, এসবের কোনো কিছুই আমাদের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে সে রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে
পারছে না। আমরা আজ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি আমরাও পারি।
শিল্পকর্ম : মোহাম্মদ কিবরিয়া
একটি দেশ যখন
কোনো দুরবস্থা কাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলতে থাকে, এর পেছনে সবচেয়ে
বড় যে ভূমিকা থাকে, তা হলো সঠিক এবং যোগ্য নেতৃত্ব। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় মাপকাঠি
জিডিপি প্রবৃদ্ধি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ,
সেখানে থেকে ধীরে ধীরে টানা এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে অবস্থান
করেছিল। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫
শতাংশ। এর পর থেকে কভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের প্রবৃদ্ধি
অর্জন বাধাগ্রস্ত হলেও ধীরে ধীরে আবার অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। এ সময়ের মধ্যে
আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন।
দেশের উন্নয়নে এ রকম আরও বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আগামী দিনে
অর্থনীতি আরও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল
প্রকল্পের বাস্তবায়ন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর
প্রকল্প, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নসহ আরও কিছু
প্রকল্প রয়েছে, যার কিছু সম্পন্ন হয়েছে এবং দুয়েক বছরের মধ্যে বাকিগুলো সম্পন্ন হওয়ার
পর দেশে বিপুল কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগের হাতছানি অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশের এ এগিয়ে চলার পথে কিছু দেশ যেমন আমাদের সহযোগী হতে চাইছে, একইভাবে কিছু
দেশ রয়েছে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চাইছে।
আমাদের উন্নয়নের
পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা এ মুহূর্তে বিদ্যমান রয়েছে, সর্বাগ্রে আলোচনা করতে গেলে আমরা
দেখব এর নেপথ্য কারণ বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এদিক বিবেচনায়
আজকের বাংলাদেশের জন্য স্বকীয় অবস্থান ধরে রাখা হয়তো কঠিন হতো, যদি আমরা আমাদের বৈদেশিক
নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্যের যথার্থ প্রকাশ ঘটাতে না পারতাম। বৈদেশিক
নীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আর সেজন্যই ভারত-চীনের মধ্যে
ঐতিহাসিক বৈরিতা থাকার পরও উভয় দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আমাদের
নেতৃত্বের বিচক্ষণতা এবং দক্ষতাকেই প্রমাণ করে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের
সীমানা সমস্যা যেমন মিটে গেছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাসেও আমরা
অনেকটা কাজ করতে পারছি। বর্তমানে ভারতের কাছে এ বার্তাই প্রতিষ্ঠিত য্ বাংলাদেশ যেমন
তার নিজ স্বার্থে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর
কাছেও বাংলাদেশের গুরুত্ব কম নয়। বাংলাদেশের উত্তর-পুবে ভারতের সাত রাজ্যের রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা ভারতের জন্য এক বড় প্রাপ্তি।
আন্তঃসীমান্ত
সংঘাত অতিক্রম করে দুই দেশই এখন অভিন্ন স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। আর এর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের
দমন, মাদক পাচার-চোরাচালান রোধ এবং সীমান্তহত্যা বন্ধের মতো বিষয়ে দুই দেশই উল্লেখযোগ্য
উন্নতি সাধন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, ভারতের
কাছে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কোনো প্রতিবেশী নেই। নেপাল, ভুটান,
মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতকে এ অঞ্চলে অনেকটা
নিঃসঙ্গ করে ফেলেছে। নিজের নিরাপত্তা এবং বাজার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে তাদের
সবচেয়ে বড় ভরসা। আর এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বড় দরকষাকষির জায়গায় অবস্থান
করছে, যার জেরে চীনের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেছে।
মজার বিষয়, চীনের সঙ্গে জাপানের ঐতিহাসিক বৈরিতা থাকলেও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়
জাপানের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এসেছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর
প্রকল্প বাস্তবায়নের পর পুরো এলাকা ঘিরে জাপানের বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আসতে
যাচ্ছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে আমাদের ভূকৌশলগত অবস্থান এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সমন্বয়ে।
এ কারণে উল্লিখিত দেশগুলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের
সহজলভ্য কাঁচামাল, যাতায়াত এবং যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও শ্রমশক্তির সহজলভ্যতা
বিদেশিদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে আমাদের।
বিশ্বরাজনীতিতে
প্রভাব বিস্তার করতে গেলে নিঃসন্দেহে সবার আগে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা জরুরি। সেজন্য
দরকার বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যে কৌশলী হওয়া। এ লক্ষ্যে শত্রুমিত্র এবং জাতীয় স্বার্থের
আলোকে ভালোমন্দের বিশ্লেষণ জরুরি। বাংলাদেশের আজকের যে অর্থনৈতিক উত্থান, এর পেছনে
রয়েছে সে রকম উপলব্ধি। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে কার সঙ্গে কতটুকু সম্পর্ক আমাদের জাতীয়
স্বার্থ অধিক গুরুত্ব দেবে, সেসব বিবেচনায় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়
সামগ্রিক সম্পর্কের উন্নতির যেমন বিকল্প নেই, একইভাবে চীন কেবল এশিয়ার মধ্যে পরাশক্তি
নয়, তারা বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব বিস্তারকারী রাষ্ট্রের একটি। এ অঞ্চলে চীন, ভারত,
জাপান যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য সহায়ক, এর বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি
পরিচালিত হয়ে আসছে নিজেদের শক্তিমত্তা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে। তারা যখন
যে দেশকে সহায়তা দিয়েছে, এর বিনিময়ে শর্তহীন আনুগত্য প্রত্যাশা করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও
এর ভিন্নতা ছিল না। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে তাদের স্বার্থের টানাপড়েনে তারা বাংলাদেশকে
জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। বাংলাদেশের নিজের মতো করে এগিয়ে চলাকে তাদের স্বার্থের
পরিপন্থী বিবেচনা করে বিধায় আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে
যখন তখন অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করতেও দ্বিধা করছে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয়
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে কোয়াডে (চতুঃপক্ষীয় ফোরাম) বাংলাদেশকে
তারা যেমন চেয়েছে, একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস)
বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেছে। বাংলাদেশ নিজেদের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সুবিধার
বিবেচনায় আইপিএসের চেয়ে চীনের নেতৃত্বে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) অধিকতর
সুবিধা বিবেচনা করায় যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে বাংলাদেশের
মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের অংশগ্রহণ তাদের সে লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
করছে। চীন ও তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনায় বাংলাদেশ বরাবরই একচীন নীতির অবস্থানে থেকে চীনের
সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে দক্ষিণ
চীন সাগর নিয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা চীনের দিকে ঝোঁকা। এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা শক্তির পক্ষ থেকে রাশিয়াকে বর্জনের যে ডাক দেওয়া হয়েছে, তা অনেকটা
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জোরপূর্বক যুক্তরাষ্ট্রমুখী করার এক ধরনের প্রচেষ্টা। আমাদের অবস্থান
এ ক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট, আর সেজন্যই চীনের বাইরেও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয়
সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারেনি।
সম্প্রতি পশ্চিমা
দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। বাংলাদেশের
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ নিয়ে তারা যেভাবে আমাদের জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ
করতে চেয়েছিল। নির্বাচনের পর এক এক করে সব দেশের পক্ষ থেকে যখন নতুন সরকারকে অভিনন্দন
জানিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করার অভিপ্রায় প্রচার হতে থাকল, এমন অবস্থায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের
যেন নিদ্রাভঙ্গ হলো! সবশেষে তারাও নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাল এবং সম্পর্ক আরও সামনের
দিকে অগ্রসর করে নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করল। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আমরা
এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি
যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় স্থিতিশীল এক অবস্থায় রয়েছে,
এ সবই দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে পশ্চিমাদের আরও চিন্তিত করে তুলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মতো ভৌগোলিকভাবে
গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কেবল ভারতকে সামনে নিয়ে এগোলে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া সম্ভব
নয়, এ ক্ষেত্রে ভারতের পরমমিত্র বাংলাদেশকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই—এটাই বাস্তবতা।