প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ২
আহসান এইচ মনসুর
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৯ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ০০:১৬ এএম
আহসান এইচ মনসুর
দেশের আর্থিক
খাতে সুশাসন ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব নতুন কিছু নয়। দেশের ব্যাংক খাত খেলাপি
ঋণে জর্জরিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের কথা বলছে। যাদের ঋণখেলাপি বলা হয় তারা যৌক্তিক
কারণেই ঋণখেলাপি হতে পারেন। দেখা যাবে, তাদের ঋণের পরিমাণও অল্প। মূল ঋণ নিয়েছে অল্প
কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর্থিক খাতে অনিয়ম এবং কতিপয় অসাধু দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে
আইনের নানা সুবিধা নিয়ে তারা ঋণখেলাপির তালিকা থেকে সরে যেতে পারেন। ফলে এই বড় প্রতিষ্ঠান
বা ব্যক্তিদের ঋণখেলাপি হিসেবে দেখানো হয় না। গত কয়েক বছরে আর্থিক খাতে নানা রকমের
কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব খেলাপি ঋণের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে
ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারও কিছু ভুল পদক্ষেপ
নিয়েছে। যেমন- সরকারি ব্যাংকগুলোকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা হয়।
শিল্পকর্ম : নিতুন কুণ্ডু
সরকারি ব্যাংকগুলোকে
রক্ষণাবেক্ষণ, নজরদারি ও সুষ্ঠু পরিচালনায় সহায়তা প্রদানের সক্ষমতা সরকারের আর্থিক
প্রতিষ্ঠান বিভাগের নেই। কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলোকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে
নিয়ে আসার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগের ক্ষমতা বেড়ে গেল। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা
হলো খর্ব। এর আগে সরকারি ব্যাংক ব্যাপক উন্নতি করছিল। সম্প্রতি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে
ভালো ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। অর্থাৎ দুর্বল
ব্যাংকগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে সবল ব্যাংকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে সংকটের
সমাধান হতে পারে না। বরং আর্থিক খাতে সুশাসনের বিষয়টিকে দিতে হতো আলাদা গুরুত্ব। দুর্বল
ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রক্রিয়া, আলোচনা ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে।
অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র
হিসেবে ব্যাংকিং খাতের বিগত সাত-আট বছরের উন্নতি আমাদের জন্য ইতিবাচক হলেও সরকারি ব্যাংকের
নিয়ন্ত্রণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে নিয়ে আসার পরই খেলাপি ঋণ বাড়তে শুরু করল।
সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ার এটি প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণটির সঙ্গে রাজনীতির যোগ
রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালক পর্ষদে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই নিয়োগ
পান। ফলে ব্যাংকিং খাত তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার নিয়োগপ্রাপ্ত
দায়িত্বশীলদের অনেকেই অসদুপায় অবলম্বনে ঋণ বিতরণ করার প্রক্রিয়া করে দেন। বিতরণ করা
ঋণের বেশিরভাগই অসৎ উপায় অবলম্বন করে এমন লোকদের ঋণ দেওয়া হয়, যারা পরবর্তী সময়ে ঋণের
টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করছে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে
জড়িত থাকে বলে ঋণখেলাপিরা বাড়তি সুবিধা পান। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি মালিকানাধীন
ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অসৎ উপায়ে
বহু ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম
ছিলÑ কোনো ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের মূলধনের ৫ শতাংশের বেশি ঋণ
দিতে পারবে না। ৫ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ করে তা ফেরত পাওয়ার সক্ষমতা ছিল না বলেই ২০০১
সালে এই নিয়ম চালু করা হয়। ২০১০ সালের পর এই নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকিং খাতে
অসদুপায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়।
খেলাপি ঋণ কমিয়ে
আনার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও সদিচ্ছার সমন্বয় জরুরি। কিছু কিছু বিষয়ে স্বল্পমেয়াদি
পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে হবে। একই সঙ্গে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদি
ও বড় পরিকল্পনা নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করা
গেলে এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। কিন্তু বারবার প্রশ্ন উঠছে, ব্যাংক খাতে সুশাসন
কতদূর? আর সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়া
যাবে এমনটি নয়। সেজন্য কয়েক বছর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে কাজ
করতে হবে। আইএমএফ আমাদের অর্থনীতির গতির স্বার্থে তারা একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। সম্প্রতি
বিশ্বব্যাংকের ১৬ বিলিয়নের ঋণে আরও সংস্কারের শর্ত দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক আনা বেয়ার্দের ঢাকা সফর অবশ্যই এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিশ্রুত ৫০টি প্রকল্পের
আওতায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কারের কথা রয়েছে।
আমরা জানি, আর্থিক
খাতে সংস্কারের বিষয়ে আইএমএফেরও বেশ কিছু শর্ত। আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংক অথবা আইএমএফের
বেঁধে দেওয়া শর্ত দীর্ঘমেয়াদে আমাদের অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে সহায়তা করবে না। বিদ্যমান
অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে এই শর্তগুলো আমাদের জন্য মন্দ কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুফলের
জন্য আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থিক খাতকে গ্রাহক সংবেদনশীল
এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম করে তুলতে হবে। তাৎক্ষণিক সংস্কারমূলক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা এই মুহূর্তে জরুরি। কারণ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কাজের কাজ হয়নি
কিছুই। আর্থিক খাতের লক্ষ্যমাত্রাকে রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো আকারে প্রচার করলে হবে না।
সেটি ফাঁপা বুলি হয়ে থাকে। আমাদের এখন প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ।
প্রশ্ন হচ্ছে,
আর্থিক খাতের দৈন্যদশা দূর করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে কি না। আমাদের ব্যাংকিং খাতে
সফল সংস্কার অতীতে একাধিকবার ঘটেছে। ১৯৯২-৯৩ সালে একবার হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ২০০১
সালে অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করা হয়েছিল। অর্থাৎ অর্থনীতির
চাহিদা অনুসারে ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু সক্ষমতা থাকলেই
সমস্যার সমাধান হয় না। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সদিচ্ছা এবং তাৎক্ষণিক ফলপ্রসূ
উদ্যোগ নেওয়ার মানসিকতা রাখা জরুরি। সরকারি ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতির অসংখ্য নজির রয়েছে।
অসাধু ব্যবসায়ীরা বা বড় প্রতিষ্ঠান অসদুপায় অবলম্বন করে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। এভাবে যাচাই-বাছাইয়ের
মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা গেলে খেলাপি ঋণের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। বিগত কয়েক বছরে এমন
একাধিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব খেলাপি ঋণের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে
ব্যর্থ হয়েছে। যেসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, সেসব বিষয়
তারা এড়িয়ে যায়। যারা ভালো কাজ করে তাদের শাস্তি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর যারা খারাপ
কাজ করে তাদের বিষয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয় না। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব সর্বাগ্রে
দায়ী।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত
করে আর্থিক খাতকে অর্থনীতির তাত্ত্বিক ধারা অনুসারে পরিচালনা করতে হবে। অর্থনীতি এক
সংকটময় মুহূর্ত পার করছে। এখন আর্থিক খাতে সুশাসন ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। ব্যাংকিং
খাতে দ্বিমুখী নীতি আমাদের জন্য ক্ষতিকর। অনেককে ঋণখেলাপের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ
কৃষিঋণ বিতরণের পর কৃষকদের নানাভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা
নেওয়ার বিষয়টি মোটেও ঠিক নয়। ব্যাংকিং খাতে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি বাড়তি সুবিধা আদায়
করবে এবং যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য তাদের ভোগান্তি পোহাতে হবে—এমনটি হতে পারে না।
আমাদের ব্যাংকিং
খাত সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা বেশ কম। ব্যাংকিং সেবা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। তবে বিষয়টিকে
নেতিবাচক ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের ব্যাংকিং সেবার সম্ভাবনা ব্যাপক হলেও এর পরিসর
ক্ষুদ্র। যারা আমানত রাখবেন তারা সেবা সম্পর্কে জানে্ন। কিন্তু ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে
অনিয়ম, জবাবদিহি ও নজরদারির অভাব কাটানোর আশুব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। দক্ষতা
ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে পরিচালিত হোক ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও
সংকটের স্বরূপ ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। নতুন সরকারের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জও তৈরি
হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি আমাদের জন্য যেমন একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়,
তেমনি মুদ্রা বিনিময় হার নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। অর্থনীতিকে বেগবান করার জন্য ব্যাংকিং
ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি
প্রণয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে। তবে এই সংস্কার স্বল্পসময়ে করা সম্ভব
নয়। বরং সংস্কারের কার্যক্রমকে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এই দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে। একটি মধ্যমেয়াদি
পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। সরকারের মধ্যে ও বাইরে বিশেষজ্ঞদের
সমন্বয়ে এই টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ব্যাংকিং খাতকে সুসংহত
করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই। তবে তা যেন ধারাবাহিক ও কার্যকর হয় সেদিকেও লক্ষ্য
রাখা জরুরি।