প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ২
ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪ ১০:৫০ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ০০:১৬ এএম
ড. আতিউর রহমান
বাংলাদেশের অর্থনীতি
এ মুহূর্তে এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ট্রিলিয়ন ডলারের সমৃদ্ধ অর্থনীতি
হওয়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং অভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনের
কারণে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়কে
চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথরেখাকে আঁকতে
গেলে অনেক ধরনের অনিশ্চয়তার কথা মাথায় রাখতে হয়। বাংলাদেশের বেলায়ও তা পুরোপুরি সত্যি।
বিশেষ করে সরকারের নীতিমালা, বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং জনগণের
এসবের সঙ্গে খাপখাওয়ানোর দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত কিছু সত্ত্বেও
এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে, বাংলাদেশ আগামী দিনে তার চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির
ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। এগিয়ে যাওয়ার এই ধারাকে আগের মতোই সমর্থন জুগিয়ে যাবে
বস্ত্র খাত, প্রবাসী আয়, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং কৃষি খাত। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি
এবং নীতির পরিবর্তনেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশেষ করে,
আমাদের শিল্পায়নের বিরাট অংশ রপ্তানিনির্ভর। বিদেশের অর্থনীতির পরিবর্তন এই শিল্পের
চাহিদাকে সহজেই বদলে দিতে পারে। তাই সর্বদাই চোখ-কান খোলা রেখে আমাদের শিল্প ও বাণিজ্যনীতি
প্রয়োজনমতো সাজাতে হবে।
তা ছাড়া আমাদের
উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার, বাড়ন্ত বৈদেশিক ঋণের বোঝা ও তার পরিশোধের ধারা এবং বাজেট ঘাটতির
ব্যবস্থাপনাও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে দুটো খাতের
ওপর এই মুহূর্তে বিশেষ নজর রাখতেই হবে। একটি হলো বস্ত্র খাত, আরেকটি প্রবাসী আয়। নানা
প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ দুটো খাত এখন পর্যন্ত যথেষ্ট শক্তিমত্তা দেখিয়ে আসছে। এ বছরও
তাদের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচকই রয়েছে। তবে আগামী দিনে এ দুটো খাত কেমন অবস্থানে থাকবে, তা
নির্ভর করবে দেশের বিনিময় হার নীতি এবং বিদেশে আমাদের বস্ত্রপণ্যের চাহিদার ওপর। তা
ছাড়া যেসব দেশে আমরা বস্ত্রপণ্য বিক্রি করি এবং জনশক্তির রপ্তানি করি, সেসব দেশে যদি
কাজের সুযোগ কমে যায় তাহলে নিশ্চয় আমাদের এ দুটো খাতের রপ্তানির পরিমাণ কমবে। অন্যদিকে
আমাদের টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে তাহলে বিদেশ থেকে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়Ñ
দুই-ই বেশি বেশি আসবে। কিন্তু তা নাহলে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের যে
পার্থক্য তা বিরাট হয়ে গেলে আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় দেশে আসার পরিমাণ
কমতে পারে। সেজন্য বিনিময় হার দ্রুত বাস্তবানুগ এবং প্রেডিক্টেবল করার কোনো বিকল্প
নেই। একই সঙ্গে রপ্তানি খাতকে আরও বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
কৃষির পাশাপাশি
আমাদের শিল্প খাতও দেশের ভেতরেই ভোক্তাপণ্য উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা পালন করে চলেছে। কৃষির
কথাই ধরুন না। কৃষি আমাদের খাদ্য চাহিদার প্রায় পুরোটাই পূরণ করছে। আজকাল অনেক বিদেশি
ফলমূলও নয়া কৃষি উদ্যোক্তারা উৎপাদন করছেন। আজকাল আমাদের কৃষি ফসলি খোরপোষ উৎপাদনের
বাইরে গিয়ে বাজারের জন্যও উৎপাদন করছেন। মাছ, মাংস, মুরগির চাহিদা দেশের উদ্যোক্তারাই
পূরণ করছেন। এখন বিদেশেও কৃষিপণ্য রপ্তানি করছি আমরা। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের কৃষিপণ্যকে
আরও উন্নত পর্যায়ে বাছাই, প্যাকেজ, সংরক্ষণসহ রপ্তানিমানে উন্নীত করা। সেজন্য কৃষির
সঙ্গে আমাদের বিজ্ঞানী, বিদ্বান ও শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তাদের যুক্ত হতে হবে। সরকারকেও
সংরক্ষণে আরও মনোযোগী হতে হবে। পূর্বাচলে সরকার কৃষিপণ্যের সংরক্ষণের বড় অবকাঠামো গড়ে
তুলছে রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে। এমন আরও উদ্যোগ দেশের নানা অংশেই গড়ে তোলা জরুরি।
কৃষি ছাড়াও দেশের
ভেতরে কৃষি যন্ত্রপাতি, রেফ্রিজারেটর, সোলার প্যানেলসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনের সুযোগ
রয়েছে। ধোলাই খাল কিংবা বগুড়ার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে আমাদের প্রকৌশল
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের কেন যুক্ত করা সম্ভব হয়নি,
সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সেদিন আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কয়েকজন সফল কৃষকের সঙ্গে
আলাপে বসেছিলাম। এদের বেশিরভাগই ছিলেন প্রকৌশলী। তারা বিদেশ থেকে প্রযুক্তি এনে দেশের
ভেতরে উন্নত মানের মাছ, সবজি, ফলমূল উৎপাদন করছেন। দেশি অর্থনীতিতে প্রযুক্তির এই সম্মিলন
আমাদের তরুণরাই ঘটাতে পারেন। সেজন্য তাদের প্রশিক্ষিত ও উৎসাহী করা দরকার। তাদের জন্য
দরকার উপযুক্ত সম্মান ও অর্থায়নের সুযোগ করে দেওয়া। নিশ্চয় আমাদের নীতিনির্ধারকরা এই
সফল কৃষকদের চাওয়া-পাওয়ার আলোকে নীতি কাঠামো তৈরি করতে পারেন।
আমাদের অর্থনীতির
যে চাঙ্গাভাব তার পেছনে আমাদের নারী উদ্যোক্তা ও শ্রমিকের অবদান অসামান্য। লাখ লাখ
নারী উদ্যোক্তা গ্রামগঞ্জে কৃষি ও ক্ষুদে শিল্পের মালিক। তারা আবার অনেক নারীকে কর্মী
হিসেবে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে আমাদের তৈরি পোশাক ও চামড়াজাত শিল্পে লাখ
লাখ নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এরা সর্বজনীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে কাজের সন্ধানে
শহরে এসেছেন। করে করে শিখছেন। ধীরে ধীরে তারা এক সময় ছোটখাটো ব্যবস্থাপক ও তত্ত্বাবধায়কও
হচ্ছেন। এভাবেই ‘করে করে শেখার’ এক নয়া শিক্ষা সংস্কৃতি তারা চালু করেছেন। এর সুফল
আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি পাচ্ছে। গ্রাম ও শহরের মাঝে সংযুক্তি বেড়েছে তাদের জন্য। অবশ্য
বাংলাদেশে সড়ক ও রেল অবকাঠামোর যে ব্যাপক উন্নয়ন সরকার করেছে তার ফলে এই সংযুক্তি বাড়ানো
অনেকটাই সহজতর হয়েছে।
ডিজিটাল অর্থনীতির
বিকাশেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই সফল। আগামী দিনে আইসিটিনির্ভর এই শিল্পের আরও
বিকাশ হবে। ডজনখানেক আইসিটি পার্ক সম্পন্ন হওয়ার পথে। এসব পার্কে নয়া প্রযুক্তিনির্ভর
ডেটা ব্যবস্থাপনা শিল্প, আউটসোর্সিং সার্ভিস খাতের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে। এখনই প্রায় সাত
আট লাখ তরুণ আউটসোর্সিংয়ে যুক্ত। এদের এবং নতুনদের আরেকটু প্রশিক্ষণ ও আর্থিক লেনদেন
সুবিধা দিতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তারা বড় পরিবর্তন এনে দেবেন। এই ডিজিটাল খাতই
এক সময় আরএমজি খাতের মতো প্রসার লাভ করবে।
শিক্ষাক্ষেত্রের
যেমন খুশি তেমন প্রসারের ভ্রান্ত পথ থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। উপযুক্ত জনশক্তি নির্মাণে
আমাদের শিক্ষা খাতকে ভূমিকা রাখতেই হবে। যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা একটি বিচক্ষণ
শিক্ষানীতি হতে পারে না। ভালো মানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তৈরি না করতে পারলে শিক্ষা
খাতের আমাদের এই বিপুল বিনিয়োগ জলে পড়বে। শিক্ষা খাতের এই চ্যালেঞ্জ হৃদয়ঙ্গম করার
সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে। এমন হতচ্ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা অসংখ্য অদক্ষ ‘শিক্ষিত’ তরুণ সৃষ্টি
করবে মাত্র। এরা নিজেরা হতাশায় ভুগবে এবং সমাজকেও কলুষিত করবে। তাই শিক্ষাক্রমে আরও
জীবনঘন করা ও অর্থনীতি সহায়ক উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করে যেতেই হবে।
এ মুহূর্তে আমাদের
সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থেই অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আহরণে ডিজিটাল প্রযুক্তির
ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশ থেকে সরাসরি বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক
আর্থিক ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএমএফ, জাইকা থেকেও
আর্থিক সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ
মোকাবিলার জন্য দেশি এবং বিদেশি সম্পদের সমাবেশে নীতি মনোযোগ দিতে হবে। আগামী দিনের
অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ আসবে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি থেকে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের
অন্যতম প্রধান শিকার। ইতোমধ্যেই উপকূল, নদীভাঙন, চর ও হাওর এলাকা থেকে অসংখ্য জলবায়ু
শরণার্থী ঢাকাসহ বড় বড় নগরে চলে আসছে। এতে নগর দারিদ্র্যের পরিমাণ বাড়ছে। তাই জলবায়ু
অর্থায়ন ও সবুজ অর্থনীতির বিকাশে নীতিনির্ধারকদের আরও মনোযোগী হতে হবে। বাড়ন্ত আয়বৈষম্য
আগামী দিনের অর্থনীতির আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। এখনই রাজস্বনীতিকে ঢেলে না সাজালে
এই সংকট তীব্রতর হবে।
তাছাড়া আগামীর
অর্থনীতির বিকাশের ধারা কতটা নির্বিঘ্ন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে শাসনব্যবস্থার সক্রিয়তা,
স্বচ্ছতা, উপযুক্ততা এবং দেশ-বিদেশের চাহিদা অনুভবের সক্ষমতার ওপর। আশা করি, আমাদের
নীতিনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত সবাই আগামী দিনের অর্থনীতির প্রয়োজনীয় গতিপ্রকৃতি হৃদয়ঙ্গম
করে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির মহাসড়কে সার্থকতার সঙ্গে পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।