আল মাসুম হোসেন
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৩ ১৬:২৮ পিএম
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৩ ১৬:৩০ পিএম
হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ - ১৯ জুলাই ২০১২)
প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে খবর আসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ নিখোঁজ। কোনো পরিবারের সন্তান, মা-বাবা কিংবা ভাই-বোন হারিয়ে গেছে। কেউ আবার মরিয়া হয়ে খুঁজছে স্বামী বা স্ত্রীকে। খবরগুলো শোনার পর আমরা কি কেউ ভেবে দেখেছি যে স্ত্রীর স্বামী হারিয়ে গেল তার কী অবস্থা?
যে ছেলের বাবা হারিয়েছে অথবা যে মায়ের কোল শূন্য হয়ে গেল তার মনের অবস্থা কী? তারা কতটা আশা নিয়ে থাকেন নিখোঁজ হওয়া প্রিয় মানুষটা একদিন ঠিক ফিরে আসবেন। সব সময়ই আতঙ্কে দিন যাপন করেন, এই মনে হয় কোনো খারাপ খবর শুনতে পাবেন। আচ্ছা, তারা কি আজীবন হারিয়ে যাওয়া মানুষের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন?
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসে যাদেরকে ঘিরে কাহিনী রচিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম চরিত্র হাসান সাহেব। তিনি একটি অফিসে কর্মরত এবং ঘটনাক্রমে হারিয়ে যান। স্ত্রী সুরাইয়া পুরো একটা জীবন একরাশ ভালোবাসা ও অভিমান নিয়ে হাসান সাহেবের জন্য অপেক্ষা করে। তাদের ছেলে ইমন কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির। সে প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলতে চায় না। বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর মামার বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকার কষ্ট, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া দুর্ব্যবহার তাকে আরও গম্ভীর করে দিয়েছে। এই কষ্টময় বাস্তব জীবন থেকে লুকিয়ে থাকতে সে পড়ালেখাকেই একমাত্র আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। উপন্যাসের নায়িকা মিতু, সে সুরাইয়ার ভাই জামিলুর রহমানের মেয়ে। উপন্যাসের সবচেয়ে সাহসী চরিত্র। নিজের যা মন চায় কিংবা যেটা ভালো মনে হয়, সেই কাজটা করার সাহস তার আছে। সুযোগ পেলেই সে তার ফুপাতো ভাই ইমনকে নানাভাবে বিরক্ত করে। তবে এর মাঝে এক ধরনের ভালোবাসা লুকায়িত। সুরাইয়ার মেয়ে সুপ্রভা উপন্যাসের সবচেয়ে উচ্ছল ও প্রাণবন্ত চরিত্র। তার জন্মের কয়েক মাস আগে বাবা হারিয়ে যাওয়ায় ছোটবেলা থেকেই সে কিছুটা অবহেলায় বড় হয়েছে। সুরাইয়ার বড়ভাই জামিলুর রহমান পুরো জীবনটাই নিজের ব্যবসার মাঝে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। যদিও তিনি ভাগনিকে তার মেয়ের থেকে বেশি ভালোবাসেন।
এ ছাড়াও আরও কিছু ছোট চরিত্র এই উপন্যাসে রয়েছে। যার মধ্যে ইমনের ছোটচাচা ফিরোজ, সুরাইয়ার ভাবি ফাতেমা, মিতুর বড়ভাই শোভন, থিওসফিস্ট রকিব সাহেব প্রমুখ। মূল কাহিনীতে এদের তেমন ভূমিকা নেই, কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর গল্প গঠনেই বরং ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়।
হুমায়ূন আহমেদ রচিত বাকি সব উপন্যাসের মতো অপেক্ষা উপন্যাসেও কিছু উক্তি আছে যেগুলো চিরাচরিত নিয়মেই আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। যেমনÑ ‘হাসলে মেয়েদের যতো সুন্দর লাগে, হাসি চেপে রাখলে তার চেয়ে দশগুণ বেশি সুন্দর লাগে।’ অথবা ‘মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না, আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্যে।’
কালরাত হয়, কখনও কালদিন হয় না। কেননা রাতে ছোট বিপদও অসহনীয় পর্যায়ে থাকে। মানুষ বিপদে পড়লে অন্যের সাহায্য লাগবেই। ব্যাপারগুলো কোনো জাগতিক নিয়মের মধ্যে পড়ে না। মিথ্যা কথা বললে দোষ হয়, লিখলে হয় না এবং খারাপ মানুষের কথা সুন্দর হয়। এমন অনেক বর্ণনার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ তার অসাধারণ বিলোকন ক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন এই উপন্যাসে।
‘অপেক্ষা’ উপন্যাসে একটি পরিবারের প্রায় ৩০ বছরের কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। বইটি পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমি নিজেই এই উপন্যাসের একটা চরিত্র। বিশেষ করে সুপ্রভা যখন মারা গেল, তখন খেয়াল করলাম মনের অজান্তেই চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমেছে। আমার ভাবনাগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এসেছে। কতই না বিচিত্র মানুষের জীবন! উপন্যাসের শেষদিকে কী হয় তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু লেখক শেষ লাইনটি লিখলেন না। হয়তো অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েছে, কিংবা এই অপেক্ষার প্রহর কখনোই ফুরাবে না!