সাব্বির ফকির
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৩ ১০:২৩ এএম
আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সন্ধ্যা নদী। যার পাড়ে বসলে প্রাণ জুড়ায়। আহ্ কী বাতাস! সেই স্নিগ্ধতা ছেড়ে যেতে মন চায় না। আমি আর কুসুম এই নদীর তীরে কত যে সময় পার করেছি তা এই সন্ধ্যা নদী আর আকাশের চাঁদ জানে।
কুসুম আমার প্রাণভোমরা, ভালোবাসা। সে যেমন রূপবতী তেমনি লাজুক। রোজ নিয়ম করে সন্ধ্যার পাড়ে আমাদের দেখা হয়। একদিন দেখা না হলে দিনটি যেন অপূর্ণ মনে হয়। তার সাথে মুখের চেয়ে চোখের কথাই বেশি হয়। কুসুমের দুই নয়নে একবার ডুবলে আমার আর হুঁশ থাকে না। তার বাম চোখের নিচে একটা কাটা দাগ আছে। দেখতে যেন অর্ধ চাঁদের মতো। মনে মনে আমি বলি, সেই চাঁদটি যদি আমি হতাম তবে সারাক্ষণ তার সঙ্গী হতে পারতাম।
তার সঙ্গী অবশ্য হয়েছি। এই বছর জানুয়ারিতে আমাদের বিয়ে হয়েছে। না না পালিয়ে নয়। দুই পরিবারের সম্মতিতে আয়োজন করে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ের পর কুসুম বলে, জানো কাদির মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি না তো! কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই স্বপ্নের মতো করে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আর আজ আমরা একই ছাদের নিচে বসবাস করছি। কুসুমের কথা শুনে মনে ভারি আনন্দ পাই। বলি স্বপ্ন তখনই সত্য হয়, যখন ভালোবাসা পবিত্র হয়। আমাদের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না বলেই আজ আমরা একসাথে। এভাবে আমাদের দিন সুখে কাটতে থাকল। বিয়ের পর ভালোবাসা যেন আরও মজবুত হলো। এখন আর কোনো বাধা নেই সন্ধ্যার পাড়ে যেতে। দিন-রাত যখন মন চায় দুজন চলে যাই প্রিয় সন্ধ্যার স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হতে।
একদিন সকালে ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে কুসুম। আজ তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। পরনে হালকা খয়েরি রঙের শাড়ি, কালো ব্লাউজের সঙ্গে চুলগুলো একপাশে। ঘুম ঘুম চোখে আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলামÑ এ যেন নেশার মতো। কিছুক্ষণ পর কুসুম বলল, একটা খুশির খবর আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী তোমার খুশির খবর? সে বলল, আমাদের পরিবার পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। তুমি বাবা হচ্ছ। তার কথা শুনে আমার ঘুম পালাল। এ আনন্দ যেন প্রকাশ করার মতো নয়। ভাষায় বলে বোঝানোর নয়। কিন্তু আমাদের আনন্দ বেশিদিন থাকেনি। সৃষ্টিকর্তা হয়তো-বা চাননি আমরা একসাথে থাকি। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিল। সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছিল।
একদিন মাঝরাতে কুসুমের প্রসবব্যথা শুরু হয়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে ছটফট করছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে ডাকলাম। মা এসে অবস্থা দেখে বলল, তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি নিয়ে আয়; কুসুমকে হাসপাতালে নিতে হবে। রাত তখন ৩টা, এখন গাড়ি কোথায় পাব? তবু গাড়ির খোঁজে আমি বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটা ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার আগেই শুনতে পেলাম চিৎকার দিয়ে কান্নার শব্দ। আমার মায়ের কণ্ঠ। আমি ঘরে ঢুকতেই মা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, বাবা কুসুম আর নেই। আমি পারলাম না কুসুমকে আটকাতে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। কোনো শব্দ নেই, চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই। আজও আমি বসে আছি সেই সন্ধ্যা নদীর পাড়ে। সেই স্নিগ্ধ বাতাস, আকাশে চাঁদ! পাশে নেই শুধু কুসুম।