গালিব সৈয়দ
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩ ১৭:৪২ পিএম
চিত্রকর্ম : গুপু ত্রিবেদী
রেণু করুণ চোখে তাকিয়ে দেখছে রুদ্রর দিকে। এতদিন রুদ্র লাপাত্তা ছিল। কোথাও তার হদিস পাওয়া যায়নি। ঢাকার উত্তরায় তার মামার বাসা। সেখানেও খোঁজ করে সন্ধান মেলেনি। দিনাজপুর রুদ্রের পৈতৃক নিবাস, একদিন সে বলেছিল রেণুকে। অথচ বাড়ির ঠিকানা বলেনি। দিনাজপুর শহর তো কম বড় নয়, অত বড় একটা শহরে একা মেয়েমানুষ হয়ে কীভাবে খুঁজবে রুদ্রকে?
রেণুদের ঢাকার এই বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। দোতলা বাড়িটি যুদ্ধের পর থেকে জনশূন্য। রেণুর বাবা ও কাকারা যুদ্ধের পর কলকাতায় চলে যান। রেণুর মা অবশ্য যাননি। তিনি তার দিদির সঙ্গে বাবার বাড়ি খুলনায় চলে যান। সেই থেকে রেণুও মার সঙ্গে সেখানে থাকে। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কয়েকবার সে কলকাতা গিয়ে বাবা ও কাকাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। রেণুর বাবার সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কে চির ধরাতে বাবা কলকাতা যাওয়ার পর আর বাংলাদেশে আসেননি।
ঘরজুড়ে নীরবতা। দুজন একটি টেবিলে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে। পাশেই কেরুর মদের বোতল রাখা। রেণুর চোখে আনন্দের ঝিলিক‚ সেই সঙ্গে সামান্য অভিমান। বিপরীত চেয়ারে বসে থাকা রুদ্রর চোখে লজ্জা ও জড়তা। ১৬ মাস। এতদিন সে রেণু এবং তার পরিচিতদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেনি। না ফোন কল, না কোন চিঠি।
নীরবতা ভেঙে রেণু বলল‚ রুদ্র! এক বছর চার মাস। দীর্ঘ এ সময় কোথায় ছিলে? বেঁচে আছ নাকি মরে গেছ, কেউ কিছুই জানি না। এতদিন পর কী মনে করে এলে? রুদ্র চুপচাপ বসে রইল, কিছুই বলতে পারল না। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এক গ্লাস পানি চাইতেও যেন সাহস হচ্ছে না। টেবিলের ওপর মদের বোতল। পাশেই গ্লাস। ইচ্ছে করছে বোতলের ছিপি খুলে এক পেগ ঢেলে ঢকঢক করে গিলে ফেলতে। তাতে অন্তত গলাটা সামান্য আর্দ্রতা ফিরে পেত।
রুদ্র- রেণু তুমি মদ খাও?
রেণু- প্রসঙ্গ পাল্টালে তাই না?
রুদ্র- কই না তো।
রেণু- কেরুর ব্র্যান্ড তো তোমার পছন্দের।
রুদ্র- এই বোতল আমার জন্য?
রেণু- হ্যাঁ। কিন্তু এখন ছোঁবে না। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
রেণু ভালো করেই জানে হুইস্কি কিংবা ওয়াইনের প্রতি রুদ্রর দুর্বলতা নেই। সে দেশি ব্র্যান্ডেই অভ্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন রুদ্রের ভাড়া বাসায় প্রায়ই যেত রেণু। ওই বাসার টেবিলের নিচে কিংবা তক্তপোষের তলায় কেরুর মদের বোতল দেখতে পেত সে। রুদ্র সব সময় মদ খেত না। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা একসঙ্গে হলেই কাবাব ও ঝাল চানাচুরের সঙ্গে চলত মদের আড্ডা। একদিন রেণু রুদ্রকে বলেছিল‚ কী সব ব্র্যান্ড খাও তুমি! কেরু, এটা কোন ব্র্যান্ড হলো? খেতে হলে হুইস্কি কিংবা ওয়াইন খাও। সামান্য রেগে রুদ্র বলেছিল‚ আমি খেলে দেশিটাই খাই। বিদেশি মদে আমার লোভ নেই।
শ্রাবণ সন্ধ্যা। আকাশজুড়ে কাঠকয়লার মতো ঘনকালো মেঘ। রুদ্র ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। কেবল দূরে একটি বাড়ির গেটের কাছে ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। তবে আলোটা ম্লান। দূরের সেই ম্লান আলোয় চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো তার। রেণু এতক্ষণে বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে মদ ঢেলে বলল‚ খাও। রুদ্র রেণুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল‚ বৃষ্টি আর কদমফুলের কথা মনে পড়ে তোমার? রেণু খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল‚ পলাশপুর, সেই দোতলা বাড়িটা! পুকুরের পাড় লাগোয়া কদমগাছের সারি। মনে পড়ে, ভীষণ মনে পড়ে।
পলাশপুরে রুদ্র আর রেণুরা একই বাড়িতে ভাড়া থাকত। যুদ্ধের সময় রেণুরা সেখান থেকে চলে আসে। রুদ্র অবশ্য তার মামার সঙ্গেই থাকত সেই বাড়িতে। যুদ্ধে তার মামা শহীদ হন। রুদ্র হয়ে যায় একা, উদ্বাস্তু। রুদ্র আর রেণু পলাশপুর হাই স্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করত। বর্ষাকাল এলেই রেণু বায়না ধরত কদমফুলের জন্য। রুদ্র কদমফুল এনে রেণুর বাসার জানালার পাশে রেখে দিত। সেই কদমফুলের আশ্চর্য ঘ্রাণে বিভোর হতো রেণু।
বাইরে দমকা হাওয়া বইছে। রেণু মন্ত্রমুগ্ধের মতো রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র রেণুকে বলল‚ প্রতীক্ষা করতে পারবে? রেণু বলল‚ আবার! এবার কত মাসের অপেক্ষা? রুদ্রের উত্তর, জানি না। লাল রাজনীতি করি। মার্ক্স ও লেনিনকে গুরু মানি। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করতে পারি না। মাথার ওপর পাঁচটা হুলিয়া ঝুলে আছে। পুলিশ দেখলেই গ্রেপ্তার করবে। বোমা ফাটানোর মিথ্যে মামলায় যাবজ্জীবনও হতে পারে। তাই পালিয়ে বেড়াই। তুমি করবে আমার জন্য প্রতীক্ষা?
বুকের ভেতর একটি দীর্ঘশ্বাস চেপে রেণু বলল‚ রুদ্র, আমি অনন্তকাল প্রতীক্ষা করব তোমার জন্য। তুমি যেখানেই থাক না কেন। প্রতি বর্ষায় আমাকে অন্তত একটি কদমফুল দিতে হবে।
আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রুদ্র পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি কদমফুল বের করে টেবিলের ওপর রাখল। আজ তবে উঠি, আবার দেখা হবে। রেণু দরজা অবধি এগিয়ে এলো। রুদ্রর চলে যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। রুদ্র চলে যাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটা যেন ক্রমে বেড়েই চলল। বৃষ্টির মাঝে মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল রুদ্র। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে টেবিলের ওপর রাখা কদমফুলটি বুকে চেপে ধরল রেণু।