মোস্তাফিজুর রাহমান
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩ ১৪:২৭ পিএম
এ জীবনে বয়স বাড়তে বাড়তে বাইশে এসে ঠেকল। মনে পড়ছে চার বছর বয়সের সেই গল্পটা। মস্তিষ্ক তখন এত উন্নত না, তবুও কেন জানি ঘটনাটা খুব পরিপক্বভাবেই মাথায় রয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই বেশ রৈ রৈ স্বভাব আমার। স্থির থাকতে মোটেও ভালো লাগত না। ছেলেবেলা কেটেছে কালীগঙ্গা নদীর তীরের এক গ্রামে।
আমার এক বন্ধুর নাম অনিন্দ, তবে অনি বলেই ডাকি আমি। অনির থেকে এক বছরের বড় ভাই প্রবাল। বাসায় না বলেই আমরা তিনজনে হাঁটতে গেছি নদীর পাড়ে। ঝনগাছের ভেতর দিয়ে হাঁটছি আমরা, একটু পরই নদীর ঘাট। আমরা যেখানে গোসল করি, তার পাশেই বাঁধা থাকে নৌকা। ওই দিন ঘাটে দুটো নৌকা বাঁধা ছিল। একটা ছোট্ট ডিঙ্গি ও একটা বড় ট্রলার। আমাদের মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি এলো ট্রলারে উঠে খেলব। যেমন কথা তেমন কাজ। প্রথমে ছোট্ট ডিঙ্গিতে, সেখান থেকে কাঠ ধরে ঝুলে ঝুলে উঠলাম ট্রলারে। এই প্রথম মনে হলো একটা দুঃসাহসী কাজ করে ফেলেছি আমরা। বিজয়ের এক আনন্দ অনুভব করলাম। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম একে অ্যাডভেঞ্চার বলে। সে যাই হোক, মুহূর্তটা দারুণভাবে উপভোগ করেছিলাম।
এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলেও আমাদের খেলা চলছিল। তবে এবার শেষ করে নামতে হবে। সেই একইভাবে নামার কাজটা করতে হবে। ঘাট ও ট্রলারের মাঝে সেই ডিঙ্গি। প্রথমে ডিঙ্গিতে নেমে তারপর উঠতে হবে তীরে। প্রথমে নামল অনিন্দ, তারপর প্রবাল, এরপর নামার আয়োজন করছি আমি। কিন্তু যত সহজে উঠতে পেরেছিলাম, তত সহজে নামতে পারলাম না। ওরা দুজন নামার সময় পায়ের ধাক্কায় ডিঙ্গিটা একটু দূরে সরে গেল। আমি ট্রলারের কাঠ ধরে ঝুলে ডিঙ্গিটা ছোঁয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। এদিকে ওরা দুজন আমাকে না নিয়েই চলে গেল। আমাকে এমন বিপদে রেখে ওরা চলে গেল, খুব কষ্ট হলো।
আমার কোমর অবধি জলে ডুবে আছে। কিছুক্ষণ আগে বিশ্বজয়ের যে আনন্দ পাচ্ছিলাম, ক্ষণকাল পরই এমনভাবে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াব সে চিন্তা একবারও মাথায় আসেনি। প্রায় ৩০ মিনিটের মতো ঝুলে ছিলাম আমি। হাত অবশ হয়ে আসছিল আমার। চোখ বুজে আসছিল। একবারের জন্য যদি হাতটা ছেড়ে দিতাম, সেদিনই আমার বিশ্বজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে যেত। অতলে চলে যেতাম সেই ঘোলা জলের।
সৃষ্টিকর্তার বড় দয়া হয়েছিল সেদিন আমার ওপর। দূরে দেখতে পেলাম আমাদের পাশের বাড়ির মুনশি চাচা আসছেন। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ডাকবার মতো শক্তি আমার ছিল না। আমি তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েই আছি। অনেকক্ষণ পর চাচা আমাকে দেখতে পেলেন। চাচা এক দৌড়ে চলে এলেন আমার কাছে। ডিঙ্গি নৌকা আমার দিকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিলেন। বড় কষ্টে তীরে উঠে আসলাম আমি। ধপাস করে শুয়ে পড়েছিলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই সেদিনের কথা।
মা বলেছিলেন সেদিন আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। পরের মঙ্গলবারে কালীগঙ্গার ভোগে পাঁচ টাকার বাতাসা আর কলাপাতায় করে খিচুড়ি দেওয়া হয়েছিল।