ফৌজিয়া আহমেদ
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩ ১৭:৩১ পিএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৩ ১৭:৩২ পিএম
চিত্রকর্ম : গুপু ত্রিবেদী
বৃষ্টি শব্দটি শুনে আনন্দিত হয় না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাঙালির মন, মনন, সাহিত্য ও সংগীতে জড়িয়ে আছে বৃষ্টি। বসন্ত আমাদের ঋতুরাজ, তবে ঋতুরানী কে? সেই তকমা সম্ভবত বর্ষাকে দেওয়া যায়। কারণ বর্ষা আমাদের জীবনে প্রাণ সঞ্চার করে। দিগন্তে সবুজের সমারোহ, কবি মনে ভাবরস, প্রেমিক মনে প্রেমতৃষ্ণা সবই যেন ঋতুরানীর ছোঁয়ায় পূর্ণতা পায়।
গ্রীষ্মের খরতাপে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত মানুষ তখন হাঁসফাঁস করে একটু শীতলতার জন্য। মানুষ গাছের বিবর্ন পাতা ও ফসলের চৌচির মাঠ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গানে গানে প্রার্থনা করে, আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে। তখন ধরণীর বুকে জলের ধারা নিয়ে আসে বর্ষা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের তীব্র গরমের পর যেন মমতাময়ীর শীতল স্পর্শ।
বর্ষা যেন এক আনমনা শিল্পী। যার ভোর নেই, মধ্যাহ্ন নেই, নেই কোনো অপরাহ্ণ, সাঁঝ কিংবা নিশি। অঝোর বারিধারায় শুধুই বর্ষণের ধ্বনি। খরতাপ ভেঙে রানীর আগমনী, প্রকৃতিতে তার শ্লোক যেন বাজে সব সময়। আমাদের প্রাণ হয়ে ওঠে নিঃসংকোচ, গেয়ে ওঠে বর্ষার গান-
বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে,
কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষনে॥
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু বর্ষা। কবি মনকে খুবই দোলা দিত বৃষ্টি। আষাঢ় আর শ্রাবণ নিয়েই তিনি শতাধিক গান-কবিতা রচনা করেছেন। বর্ষার সঙ্গে অন্য ঋতুর তুলনা করতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন, ‘ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র। তাহার জুড়ি নাই। গ্রীষ্মের সঙ্গে তার মিল হয় না; গ্রীষ্ম দরিদ্র, সে ধনী। শরতের সঙ্গেও তাহার মিল হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কেননা শরৎ তাহারই সব সম্পত্তি নিলাম করাইয়া নিজের নদীনালা-মাঠঘাটে বেনামি করিয়া রাখিয়াছে। যে ঋণী সে কৃতজ্ঞ নহে।’
বৃষ্টির মাহাত্য বাঙালির মনে পরম মমতায় গেঁথে দিয়েছেন তিনি। গান, কবিতা, সাহিত্যে বর্ষার নিপুণ চিত্র তাঁর মতো এত নিখুঁতভাবে খুব কম কবিই তুলে ধরেছেন। ঘনঘোর বর্ষায় যখন আকাশ কালো হয়ে আসে, শঙ্কায় থাকে মন। ঠিক সেই মুহূর্তটি নিয়ে তিনি লিখেছেন-
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝর-ঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর,
কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে।’
বর্ষা ঋতুর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তিনি বৃষ্টির ছটাকে তুলনা করেছেন ফুলের সঙ্গে, আর আসমানের কালো মেঘকে প্রিয়তমার চোখের কাজলের। তিনি লিখেছেন-
ছড়ায়ে বৃষ্টির বেলফুল, দুলায়ে মেঘলা চাঁচর চুল
চপল চোখে কাজল মেঘে আসিল কে।
বর্ষা দিনে তিনি বিরহও অনুভব করেছিলেন হৃদয়ের গভীরে। বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় কাছের মানুষটির বিরহ ব্যথা নিয়ে তিনি লিখেছেনÑ শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে। তিনি আবার বৃষ্টিকে বলেছেন নৃত্যরতা তরুণী। বৃষ্টির টাপুর টুপর শব্দকে তুলনা করেছেন নূপুরের ঝংকারের সঙ্গে। তিনি লিখেছেনÑ রুমুঝুম রুমুঝুম কে এলে নূপুর পায়, ফুটিল শাখে মুকুল ও রাঙা চরণ-ঘায়।
নজরুল নানা আঙ্গিকে বর্ষাকে তুলে ধরেছেন গান ও কবিতায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘এসো হে সজল শ্যামল ঘনদেয়া’, ‘এসো স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণি-বর্ণা-মালবিকা’, ‘কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের বাঁশি’, ‘ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন’, ‘চঞ্চল শ্যামল এলো গগনে’, ‘বরষা ঋতু এলো এলো’, ‘মেঘলামতির ধারাজলে করো স্নান’, ‘মেঘের হিন্দোল দেয় পূর্ব হাওয়াতে দোলা’, ‘দুলবি কে আয় মেঘের দোলায়’, ‘বাজে মৃদঙ্গ বরষার’, ‘রুম ঝুম ঝুম বাদল নূপুর বাজে’। কবি বর্ষাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘প্রিয় বিরহ’ নামে।
বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে বর্ষা। কবি জসীমউদ্দীন, বুদ্ধদেব বসু, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ সবার প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। আমাদের জীবনে নানা আঙ্গিকে জড়িয়ে আছে বর্ষা ঋতু। কৃষক থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, প্রেমিক বা ভবঘুরে সবার জীবনে বর্ষার উপস্থিতি। সাহিত্য যাই হোক না কেন, বৃষ্টি ও বাঙালি একে অপরের পরিপূরক।