আনিয়া তাসকিন
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩ ১৫:০০ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বর্ষবরণ আর স্মৃতিচারণা। বৃষ্টির স্নিগ্ধতার মাঝেই কেমন যেন এক স্মৃতিবেদনা। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজতে থাকে অপার্থিব এক সুর। প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে তোলে জলরঙের ছবির মতোন। বাদলা দিনে সেই স্নিগ্ধ ধূসর রঙ ছুঁয়ে যায় কবিমন। ফিরে যায় শৈশবের দিনগুলোয়।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে শঙ্খ নদের পারে জেলেপাড়ায়। স্থানীয়ভাবে বলা হতো জাইল্যাপাড়া। সেখানেই বর্ষা উদযাপনের সব গল্প। আষাঢ় শুরু হলে নদে স্রোত বেড়ে যেত। পাড়ে আছড়ে পড়ত মাতাল ঢেউ। বিদ্যুতের ঝলকানি আকাশজুড়ে, তার সঙ্গে মেঘের গর্জন। খাল ও নদ থেকে কই মাছগুলো লাফিয়ে ডাঙায় চলে আসত। কখনও ধানক্ষেত বা মাঠে। আমরা কজন বন্ধু মিলে ছুটতাম কই মাছ ধরতে। কিছুক্ষণ পর কাদায় মাখামাখি হয়ে ঘরে ফিরতাম। মা সেই মাছ কড়া করে ভেজে দিতেন। কুপির আগুনে বসে খেতে হতো ভর দুপুরবেলায়। খাবার শেষে কুপির আগুনেই পড়ালেখা। বেশি বৃষ্টি হলে সেদিন স্কুলে ক্লাস হতো না। পড়া শেষে আমরা ছুটে যেতাম নদের পাড়ে। জেলেদের সঙ্গে আমরাও নদে নেমে পড়তাম। তেলাপিয়া, শিং, রুই, কাতলা আটকা পড়ত জালে। পাশাপাশি মলা ও পুঁটি মাছের ঝাঁক আটকা পড়ত।
আষাঢ়ের সন্ধ্যায় বারান্দায় বসত গল্পের আসর। দাদির আশপাশ ঘিরে বসত নাতিপুতির দল। গল্প জমত হরেকরকম বিষয় নিয়ে। তবে বেশিরভাগ গল্পই হতো ভৌতিক। আমাদের পাড়ার হারুন মাঝিকে একদিন নাকি মেছোভূত নিয়ে গেল। মাঝরাতে ঘরে ফিরছিল সে। হাতে ছিল ৩ কেজি রুই মাছ। সে মনে মনে বলতে লাগল, আজ বাসায় গিয়ে বউকে বলব, চটপট একটা মাছ কড়া করে ভেজে দাও। বউ বিরক্ত হলেও তাতে কী? নদ থেকে সদ্যতোলা মাছটার অমৃত স্বাদ যে না নিলেই নয়। এমন চিন্তা করতে করতে নদের পাশের ঝোপঝাড়ের কাছে সে চলে এলো। হঠাৎ শুনতে পেল কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। আর তার হাতের মাছ চাচ্ছে। পেছন ফিরতেই আঁশ আবৃত এক নারী এক ঝটকায় মাছ কেড়ে নিয়ে তাকে মেরে ফেলল।’ ভয়ংকর সেসব গল্প শুনে কাঁথা মুড়িয়ে ভয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। মাঝরাতে মেঘের গর্জনে ঘুম ভেঙে যেত।
যেদিন স্কুল খোলা থাকত আমরা বইখাতা নিয়ে দলবেঁধে যেতাম। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি এলে কলাপাতা বা কচুপাতা মাথায় ধরে স্কুলে যেতাম। হঠাৎ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলেও কোনো অভিমান থাকত না। আমরা এ বৃষ্টির নাম দিতাম ‘পাউডার বৃষ্টি’। স্কুলমাঠে মেতে উঠতাম ফুটবল বা হাডুডু খেলায়। তারপর কাদামাখা হয়ে বাড়ি ফিরতাম। কখনও কখনও দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম শঙ্খ নদে। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরে শুনতাম মায়ের বকুনি। অনেক সময় তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত সূর্যের আলোর দেখা মিলত না। কাজ না থাকলে কেউ ঘরের বাইরে যেত না। বাদলা দিনের আরামের সেই ঘুমের মধ্যেই যেন স্বর্গসুখ।
স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় বাড়ির সবাই খোশগল্পে মেতে উঠত। বড়রা তাস খেলতে বসে যেত। আর বয়স্কদের দেখতাম পাটের রশি ও মাছ ধরার বড়শি তৈরি করতে। রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা মিলত চাঁদের। জ্যোৎস্নাস্নানে সবাই নেমে পড়ত ঘরের বাইরে। বউ-ঝিরা নদের পাশে ঘুরে বেড়াত।
একদিন আমি উঠলাম নৌকায়। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আবছা আলোয় অবয়ব ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। চাঁদের আলো নদের পানিতে পড়ে প্রতিফলন তৈরি করছে। মনে হচ্ছে পানির ভেতর থেকেই আলো আসছে। আমাদের নৌকার মাঝি মতিউর গান ধরলে তার সঙ্গে গলা মেলান বড় বোনেরা। কিন্তু আমি জড়সড়ো হয়ে বড় আপার কোলে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমরা নদের ওপারে পৌঁছে যাই। যেখানে ছিল বড় আপার বান্ধবীর বাড়ি। তারা আমাদের গরম ভাতের সঙ্গে কুমড়াফুলের বড়া আর সরপুঁটি ভাজা দিয়ে আপ্যায়ন করেন। আহা! কী যে স্বাদ ছিল। বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় মায়ের বকুনি শুনতে হয়েছিল সেদিন। আমি বকুনি খেয়ে ঢেকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়লাম মায়ের পাশেই।
ঘুম ভেঙে দেখি বদ্ধঘরে একা শুয়ে আছি। বৃষ্টির ঝপঝপানি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মাটির সেই সোঁদা গন্ধ আমাদের বর্তমান বাড়ির পাঁচ তলা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ছেলেবেলার সেই ব্যাঙের ডাকের বদলে ঘড়ির টিকটিক শব্দ। বিছানা থেকে উঠে এক কাপ গরম চা বানিয়ে পা টিপে টিপে স্যাঁতসেঁতে বারান্দায় পৌঁছে যাই। বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগে শরীরে। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই কোথায় যেন বেজে ওঠে- বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার ঘ্রাণ।