পল্লী মজুমদার
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩ ১৩:১৭ পিএম
চিত্রকর্ম : শাবিন শাহরিয়ার
বাবা, শব্দটি শুনলেই মাথায় আসে সৌম্য চেহারার স্থির এক মানুষের চিত্র। যে হবে গভীর পুকুরের মতো শান্ত। সন্তানের জন্য যার থাকবে বুকভর্তি ভালোবাসা। কিন্তু গাম্ভীর্যের আড়ালে সেই ভালোবাসা রয়ে যায় অদৃশ্য। চিরায়ত বাঙালি সমাজে বাবারা বুঝি এমনই হয়ে থাকেন।
মায়ের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা যত বেশি, বাবার সঙ্গে দূরত্ব যেন ঠিক ততটাই। বাবা মানেই যেন এক ধরনের অজানা আতঙ্ক। সন্ধ্যাবেলায় তার ফেরার আগেই পড়তে বসতে হবে। না হলে তার মার থেকে রক্ষা নেই। মায়ের ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় বাবার ভয়। একটু দুষ্টুমি করলেই সেই সংলাপ, আজ বাবা আসুক নালিশ করব তোমার নামে।
শৈশবকাল থেকে আমার সহপাঠীদের দেখেছি, বাবার ভয়ে তটস্থ থাকত। স্কুলের কোনো গোপন কথা যদি বাবা জেনে যায় তবে আর রক্ষা নেই। কিন্তু আমার বাবাকে অতটা ভয়ংকর মনে হয়নি। পরিস্থিতিভেদে রাগ ও বকা দিতেন আমাকে। কিন্তু কখনও ভয়ংকর লাগেনি। তবে সে একটু অস্থির ও ক্ষেপাটে। যখন যা মনে আসে তা করে ফেলার একজন মানুষ। আমার বাবা গল্প করার মানুষ। সেই স্কুল জীবন থেকেই আমাদের নিত্যদিনের গল্প করার যাত্রা শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেও সেই ধারা চলমান। একটু আগেই বলেছি, আমার বাবা ক্ষেপাটে। বাবাকে এ কথা বলে কেউ! কেন বলেছি
তবে শুনুন- তখন আমার বয়স নয় বছর, ক্লাস ফোরে পড়ি। কয়েক দিন পর ঈদ। মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক টানাপড়েন চলছে আমাদের সংসারে। একটা ফ্রিজের অভাবে মায়ের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। একদিন বিকেলে বাবা অফিস থেকে ফিরে মাকে নিয়ে বাইরে গেলেন। কয়েক ঘণ্টা পর দেখি একটা ভ্যানে বসে বাবা আসছেন। তার পেছনের রিকশায় মা। ভ্যানে বিশাল আকৃতির দুটি কার্টন। হাসি দিয়ে বাবা বললেন, তোমাদের জন্য নতুন ফ্রিজ ও টিভি নিয়ে এসেছি। সেদিন মায়ের চেহারায় রাগের সঙ্গে চাপা আনন্দও ছিল। আর আমার খুশি আকাশ ছুঁয়েছিল।
ক্রিকেট, ফুটবলে বাবার ছিল ভীষণ আগ্রহ। ব্রাজিল সাপোর্টার বাবা আমাকে নিজে খেলার নিয়ম-কানুন শিখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা চলাকালীন আমাদের বাসায় স্পোর্টস চ্যানেল বাদে অন্য কিছু দেখা ছিল নিষিদ্ধ।
আমার বাবা এতটাই কাছের বন্ধু যে, আমার প্রথম ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দিয়েছিলেন। ইন্টারনেট কিংবা কম্পিউটার চালানো, সবই শিখেছি বাবার হাত ধরে। বাবা আমাকে অনেক বই কিনে দিতেন। তিনি বলতেন, না পড়লে জানবে কীভাবে। বাবা কখনই চাইতেন না আমি নিজেকে দুর্বল ভাবি। জীবনে চলার পথে তার কথাগুলো সব সময় মনে পড়ে। সাঁতার শিখতে হলে যেমন হাবুডুবু খেতে হয় তেমনি ব্যথা না পেলে শক্ত হওয়া যায় না। তাই জীবনে হেরে গিয়েও শেখার থাকে অনেক কিছু।
আমার বন্ধুদের দেখতাম কিছু দরকার হলে মায়ের কাছে বলতে, যেন বাবাকে বুঝিয়ে বলে। আর আমি সরাসরি বাবার কাছে। কারণ আবদারের ঝাঁপি সহজেই খুলে বসা যেত তার কাছে। মেয়ের কোনো কিছুতে যেন না নেই তার।
বাংলাদেশের প্রায় সব ছেলেমেয়ের জন্য কঠিন একসময় হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি। আমার মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমি কোনো এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে যাব। তার বিশ্বাস এক ধরনের প্রত্যাশার চাপ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই সময়ে আমার পাশে ছিলেন বাবা। তিনি বলেছিলেন, একটি পরীক্ষার ফলাফলে জীবন শেষ হয় না। তুমি পড়তে থাকো। আমি আছি, তোমার কোনো চিন্তা নেই। তুমি পড়বে আনন্দে, চাপের জন্য না।
পৃথিবীর সব সন্তানের কাছেই বাবা শ্রেষ্ঠ। তেমনি আমার কাছেও আমার বাবা সেরা। সব বাবা যদি তাদের মেয়েদের জীবন গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তবে দৃশ্যপট বদলে যাবে। বাবা তার মেয়েকে মানুষ হিসেবে দেখবে। ব্যর্থতা ভুলে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে বলবে, তুই এগিয়ে যা মা। আমি পাশে আছি। একটি মেয়ের জীবনে বাবার চাইতে অনন্য কোনো শক্তির উৎস আর নেই। অনেক ভালোবাসি তোমায় বাবা।