প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩ ১৪:৪৮ পিএম
আপডেট : ৩১ মে ২০২৩ ১৪:৫৪ পিএম
প্রচ্ছদ : সংগৃহীত
জীবনযাপনের প্রতিটি পর্যায়ে নীরব শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পাশে থাকে বৃক্ষ। সবুজ এই গাছ থেকে পাওয়া অক্সিজেন গ্রহণের মাধ্যমেই আমাদের বেঁচে থাকা। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশের সুস্থতা, সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষায়ও গাছের ভূমিকা কম নয়। ফুল-ফল-ছায়া দিয়ে আগলে রাখা গাছের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতারও শেষ নেই। আগামী ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আজকের আয়োজন।
আসমাউল হুসনা
রাস্তার দু’পাশে সারি সারি বৃক্ষরাজি। তার ডালে ডালে পাখির আবাস। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত সকাল-সন্ধ্যা। অথবা আঁকাবাঁকা নদী বয়ে চলছে আপন মনে। যার দুপাশে ঘন গাছের সারি। যার নিচে বসে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুরে একটু শান্তিতে জিরিয়ে নেওয়া যায়। এমন পরিবেশের কথা চিন্তা করলেই শীতল শান্তি ছুঁয়ে যায় হৃদয়ে।
দিনে দিনে আমাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। জীবিকা ও উন্নয়নের তাগিদে তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন, রাস্তাঘাট, কলকারখানা। যার ফলে কাটা পড়ছে অসংখ্য গাছ। কলকারখানার কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশে বায়ু দূষিত করছে। কালো ধোঁয়ায় থাকা সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, যা মানবদেহের জন্য হুমকি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই অক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। যত্রতত্র ফেলা প্লাস্টিক, কলকারখানার বর্জ্য পানিতে মিশে করছে দূষিত। প্লাস্টিক ও আবর্জনার জন্য অনেক নদীই পরিবর্তন হয়েছে গতিপথ। আবার অনেক নদী এখন মৃতপ্রায়। ফলে বাড়ছে নদীভাঙন। পরিবেশ থেকে বিপুলসংখ্যক গাছ কাটায় ফলে কমে যাচ্ছে অক্সিজেনের পরিমাণ। বাড়ছে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। বিভিন্ন পশুপাখি হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল। খাদ্য উৎপাদনও কমছে অনেক। উন্নয়নের নেশায় আমরা ভুলতে বসেছি, জীবনের জন্যই পরিবেশ। নিজেরাই ধ্বংস করছি সুন্দর এই পৃথিবীকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব সম্মুখীন হচ্ছে বিপদের।
পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। তাই প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। পরিবেশ থেকে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে আমাদের প্রত্যেকের উচিত গাছ লাগানোর ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া।
সাফা আক্তার নোলক
প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় গাছের কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ গাছবিহীন আমাদের প্রাণিজগতের কোনো অস্তিত্বই নেই। বিষয়টি আমাদের খুব ভালো করে জানা থাকলেও প্রতিনিয়ত আমরা গাছ কেটছি- কারণে, অকারণে। সভা-সেমিনারে গাছ রক্ষায় বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালেও, বাস্তবে গাছ রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার চাইতে যেন ধ্বংসেই আমরা মনযোগী । প্রয়োজন মেটাতেই তো অবশ্যই, এর বাইরে নিজের লোভ চরিতার্থ করতে গাছ কেটেই চলেছি। আর এতে করে গাছ হত্যার মধ্যে দিয়ে, নিজের তথা প্রাণিজগৎ ধ্বংস করে ফেলার নকশা আঁকছি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তারকমোহন দাস ১৯৭৯ সালে একটি গাছের অবদানকে অর্থমূল্যে পরিবর্তন করে দেখান। তার হিসাব অনুযায়ী ৫০ বছর বয়সি একটি গাছের অর্থনৈতিক মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ডলার। তিনি আরও বলেছেন, গাছ থেকে মানুষ বছরে অক্সিজেন পায় ২১ লাখ টাকা সমমূল্যের। প্রাণিসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগাড় করে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার। মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা বাড়ায় ২১ লাখ টাকার। পানি পরিশোধন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ২১ লাখ টাকার। অর্থাৎ আমাদের জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে গাছ উপকার করে যাচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমরা নির্দ্বিধায় বিলীন করে দিচ্ছি এই গাছপালার। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ ১ বছরে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ১ বছরের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে থাকে। তাই নিজেদের জীবন রক্ষার্থে গাছের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এই পৃথিবীকে প্রাণীর বসবাসের যোগ্য করে তুলতে, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গাছের কোনো বিকল্প নেই। যে গাছ তার সর্বস্বতা দিয়ে আমাদের অস্তিত্বকে বিলীন হতে রক্ষা করছে, সেই জীবের প্রতি আমাদেরও হতে হবে আরও সচেতন এবং যত্নশীল।
রেজাউল আলম
‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’- এ স্লোগানে প্রতি বছর সারা দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে রোপণ করার পর খুঁটি, বেড়াসহ গাছের পরিচর্যা নিশ্চিত হচ্ছে না। যার ফলে বৃক্ষরোপণের সঠিক যে সুফল, সেটা আমরা পাচ্ছি না।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে পরিমাণ বন ছিল তা এখন বিলীন প্রায় । জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন কেটে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি, কলকারখানা। বিদায় নিচ্ছে বনে বাস করা সব বন্যপ্রাণী। গবেষকরা বলছেন, একটা দেশের পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সর্বনিম্ন ২৫% বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬%। বাস্তবে এই পরিমাণ বনভূমি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের ছোটবেলায় দেখা মধুপুরের গড়, ভাওয়াল গাজীপুরের বন এখন প্রায় বিলীন। গাছ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। তাই নিজেদেরও পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বৃক্ষরোপণ করা অত্যাবশ্যক। তথ্যসূত্র মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গড়ে প্রতি মিনিটে সাত থেকে আট লিটার বাতাস নেন। সে হিসাবে চব্বিশ ঘণ্টায় আমরা আনুমানিক এগারো হাজার লিটার বাতাস নিয়ে থাকি। এর মধ্যে থেকে ফুসফুস কেবল পাঁচ শতাংশ বিশুদ্ধ অক্সিজেন ছেঁকে নেয় হৃৎপিণ্ডে। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫৫০ লিটার বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এই অক্সিজেনের উৎস প্রকৃতিতে থাকা পরিবেশবান্ধব গাছ। জীবন বাঁচাতে গাছের ভূমিকা ও গুরুত্ব কতটুকু, সেই প্রয়োজন আমরা বেশি অনুভব করেছি করোনাকালীন সময়ে অক্সিজেন সংকটকালে।
সারা বছর বনভূমিসহ প্রচুর পরিমাণ গাছ আমরা বিনা কারণে কাটছি। সামনের দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় হয়তো আমাদের স্লোগান থাকবে- ‘গাছ লাগান, জীবন বাঁচান’। তাই এখনই সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করে সুন্দর পৃথিবী গড়তে ভূমিকা রাখা।
সুজিত দাশ
কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। গাছের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতপক্ষে ঢেঁকি তৈরি হয় কাঠ দিয়ে, যার প্রধান উপাদান গাছ। তা হলে বলা যায় গাছ স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। একটি গাছ জন্ম থেকে মৃত্যুর পরবর্তী সময়েও সবার মঙ্গলে ব্রতী হয়। গাছ মানুষসহ প্রাণিকুলের জন্য আশীর্বাদ। ফুল, ফল, কাঠ ও সুগন্ধ দিয়ে গাছ পৃথিবীকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। যে অক্সিজেন ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা কল্পনা করা যায় না- এর একমাত্র ভরসাকেন্দ্র হচ্ছে গাছ। অক্সিজেন প্রদান করার পাশাপাশি গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্যকে ঠিক রাখে। অক্সিজেন ছাড়াও মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যতকিছু ব্যবহার করে, তার বেশিরভাগ আসে গাছ থেকে। সকাল থেকে রাত সবকিছুতেই গাছের বিচরণ। জীবনধারণের জন্য খাদ্য হিসেবে আমরা যেসব উপাদান গ্রহণ করি, তার সবকিছুর উৎপাদনস্থল গাছ। সুতরাং গাছ ছাড়া আমরা অস্তিত্বহীন।
শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণিকুলের জন্যও গাছ সমানভাবে উপকারী। গাছের ডালে ডালে পাখি বাসা বাধে। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি গাছকে নির্ভর করে বেঁচে থাকে তারা। একটি গাছ জীবদ্দশায় লাখো প্রাণীর আবাস ও ভরসাস্থল। প্রাণিকুলকে বাঁচিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করে পরোপকারী গাছ।
সময়ের সঙ্গে সভ্যতার করালগ্রাসে অমূল্য সম্পদ গাছ ধ্বংস হচ্ছে। বসবাসের জন্য গাছ কেটে, বন উজাড় করে ইমারত তৈরি হচ্ছে। পেরেক ঠুকে গাছের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হচ্ছে। সবই হচ্ছে মানুষ নামের দুই পেয়ে দৈত্যের কারণে। যারা অক্সিজেন, বাতাস, ছায়া ও খাদ্য দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে, আমরা তাকেই ধ্বংস করছি। পঙ্গু করে দিচ্ছি পুরো পৃথিবীকে। কিন্তু অনতিবিলম্বে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গাছের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। পরম বন্ধু গাছ আরও বেশি বেশি রোপণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটি পৃথিবী গড়তে উদ্যোগী হতে হবে সবাইকে।
আল মাসুম হোসেন
মানুষের পাঁচ মৌলিক অধিকার হলো- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। এসব চাহিদা গাছ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পূরণ করে। মানুষ নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের বৃক্ষের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার প্রধান অংশ ভাত, রুটি, ফলমূল, শাকসবজি ও পানীয় ইত্যাদি আসে গাছ থেকে। কাপড় বা বস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সুতা বা কটন পাওয়া যায় গাছ থেকে। মানুষসহ সব প্রাণীর বাড়িঘর তৈরিতে ব্যবহার হয় গাছ। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান কাগজ, যা তৈরির মূল উপাদান বাশ, খড় প্রভৃতি সবই বৃক্ষ। আর চিকিৎসাক্ষেত্রে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কাটা- ছেঁড়াসহ নানা কাজে ব্যবহৃত তুলা, গজ ও ব্যান্ডেজ সবকিছুই আসে গাছ থেকে।
সভ্যতার আদিকাল থেকে বিভিন্ন রকমের অসুখ সারাতে গাছগাছালির ফলমূল, ছালবাকল, পাতা ও ফুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক যুগে গাছ থেকে প্রাপ্ত রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে নানা রকমের ওষুধ। যেমন- সিনকোনা গাছের বাকল থেকে প্রাপ্ত কুইনাইন ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। আবার বাসকের পাতায় ‘ভার্সিনিন’ নামের ক্ষারীয় পদার্থ ব্যবহার করে সর্দি, কাশি ও শ্বাসনালির প্রদাহমূলক ব্যাধির ওষুধ বা সিরাপ তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়াও অনেক প্রকার ওষুধ তৈরি হয় গাছ থেকে। কিন্তু আমাদের অবহেলা, অসচেতনতা ও নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পৃথিবী আজ সংকটের মুখে। একটি দেশের বনভূমির পরিমাণ ২৫ শতাংশ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তাই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে সবাইকে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষের যত্ন ও নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।