আহরাফ রবিন
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩ ১৩:০১ পিএম
আপডেট : ৩১ মে ২০২৩ ১৩:০৩ পিএম
এস্রাজে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে- মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই...। সকালবেলা এস্রাজের সুরে ঘুম ভেঙে গেল অরূপের। সে বিছানা থেকে উঠে ঘরের দক্ষিণের জানালা খুলল। বাসার ফ্ল্যাটের দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে সুর ভেসে আসছে। এত সকালে এস্রাজ বাজায় কে? আগে তো কোনোদিন বাজাতে শোনেনি কেউ। প্রথমে বিরক্ত হলেও অরূপের এখন বেশ ভালোই লাগছে। যেই বাজাক না কেন, বেশ ভালোই বাজাচ্ছে।
হঠাৎ সুর থেমে গেল। মা ডেকে বলল, চা হয়ে গেছে। সকালবেলা চা খাওয়ার অভ্যেস অরূপের। চা খেয়েই খানিকক্ষণ বই পড়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে যায় অরূপ। সকালের নাশতা অফিসেই করা হয়।
অরূপ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল‚ দোতলার ফ্ল্যাটে কেউ এসেছে? মা বললেন‚ হুম! নতুন ফ্যামিলি উঠেছে। আনমনে অরূপ বলে উঠল, কেউ একজন দারুণ এস্রাজ বাজায়।
অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলা অরূপ দোতলার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘরের ভেতর থেকে রবীন্দ্রসংগীতের সুর ভেসে আসছে। কেউ একজন রবীন্দ্রসংগীত গাইছে।
কয়েকদিন পর নিমন্ত্রণ এলো দোতলার বাসা থেকে। জন্মদিন উপলক্ষে সন্ধ্যায় অরূপদের বাসার সবাইকে যেতে বলছে। মা অরূপকে বললেন‚ আজ অফিস থেকে ফেরার পথে একুশটা গোলাপ কিনে আনতে পারবি? অরূপ খানিকটা অবাক হয়ে বলল‚ একুশটা গোলাপ! এত গোলাপ দিয়ে কী করবে?
মা- আজ সন্ধ্যায় লাগবে। জন্মদিনের নিমন্ত্রণ আছে।
অরূপ- উপহার হিসেবে শুধু গোলাপই দেবে, আর কিছু নয়?
মা- তুই অফিসে বেরিয়ে গেলেই আমি শাড়ি কিনতে যাব।
অরূপ- কার জন্মদিন?
মা- সন্ধ্যায় এলেই বুঝবি।
অরূপ স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সন্ধ্যায় মেয়েটিকে সে দেখতে পাবে। এই মেয়েটিই তাহলে এস্রাজ বাজায়। সন্ধ্যা হলে রবীন্দ্রসংগীত গায়। ছিপছিপে গড়নের এক সাধারণ মেয়ে। গায়ের রঙ ফরসা। পরনে কালো রঙের শাড়ি। সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি ফ্লোরে বসে এস্রাজ বাজিয়ে শোনাচ্ছে সবাইকে। খানিক বাদে রবীন্দ্রসংগীতও গাইবে।
রাতের খাবার দিতে একটু দেরি হবে। হালকা নাশতা হিসেবে ট্রেতে করে চা-বিস্কুট পরিবেশন করা হচ্ছে। অরূপের কাছাকাছি আসতেই চায়ের কাপ ফুরিয়ে গেল। হঠাৎ করে মেয়েটির মা বলল‚ স্বাতী‚ ঝটপট কয়েক কাপ চা করে দাও সবাইকে।
মেয়েটি উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। খানিক বাদে নীল রঙের একটি কাপে চা নিয়ে এলো। প্রথমেই অরূপকে চা দিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অবাক হলো অরূপ। ঘ্রাণটা কেমন যেন চেনা লাগছে তার। চায়ে চুমুক দিতেই সে আরও অবাক হলো- এ কী করে সম্ভব!
অরূপদের গ্রামে একটি মেয়ে ছিল। নাম তার বীণা। সে-ও এমন চা বানাত। প্রায়ই অরূপকে চা বানিয়ে দিত সে। স্বাতীর হাতের চায়ের সঙ্গে বীণার চায়ের একটা অবিশ্বাস্য মিল রয়েছে।
কলেজ পিকনিকে তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। তারপর একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সময়ের অতলে সেই সম্পর্ক হারিয়ে গিয়েছে। অরূপ ভালোবেসে বীণাকে চেয়েছিল, বিপরীতে বীণা ছিল উদাসীন। তারপর হঠাৎ করে একদিন বীণার বিয়ে হয়ে যায়। বরের সঙ্গে সে উড়াল দেয় আমেরিকায়। আর কোনোদিন তাদের যোগাযোগ হয়নি।
আজ সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে কেন বীণার কথা মনে করে বুকের ভেতরটা নড়ে উঠল অরূপের? সে কি বীণাকে আজও মনে ধরে রেখেছে? কী আশ্চর্য! বীণা যেমনটা চায়ে এলাচ ভেঙে দিত, স্বাতীও অবিকলভাবে এলাচ ভেঙে দিয়েছে। এলাচ দেওয়া ঘন দুধের চা অরূপ এ জীবনে দুটি নারীর হাত থেকে খেয়েছে। প্রথমজন বীণা। আর দ্বিতীয়জন স্বাতী।
অনেকদিন পর আবার এস্রাজে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বাজছে। সকালের আকাশে মেঘ জমে আছে। দক্ষিণের জানালা খুলে দিতেই ঘরের ভেতর ফিনফিনে শীতল হাওয়া ঢুকতে লাগল। এস্রাজে রবীন্দ্রসংগীতের সুরটি নিরুপম হলেও এই মুহূর্তে শুনতে ইচ্ছে করছে না অরূপের। এই সুর শুনলেই স্বাতীর মুখটি ভেসে ওঠে। সেই মুখের আড়ালে আরও একটি মুখ, বীণার! যার কাছে ভালোবাসার মূল্য পায়নি, তার কথা স্মরণে আনতে ইচ্ছে করে না অরূপের। এ বড় কষ্টের।
স্বাতীর ছায়া কেন বীণার ছায়ায় এসে থমকে দাঁড়ায়? সেদিন সন্ধ্যায় স্বাতীর হাত থেকে চায়ের কাপটি নেওয়া সমীচীন হয়নি মনে মনে বলতে থাকে অরূপ।