× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চেতনার কবি নজরুল

পল্লী মজুমদার

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩ ১৪:২৮ পিএম

চেতনার কবি নজরুল

বিদ্রোহ, সংগ্রাম, কবিতা ও গান সবকিছুতে যার নাম সবার আগে মনে আসে, তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো হলেও স্থায়িত্ব ছিল নক্ষত্রের মতো। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, শিশু-সাহিত্য সব ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ ও স্বকীয় ধারা। আবার সুর-সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয়সহ শিল্পের নানা শাখায় তাঁর দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। শিল্প-সাহিত্যের যেখানেই নজরুলের ছোঁয়া লেগেছে সেখানেই তৈরি হয়েছে নতুনত্ব। তাঁর গানে ছিল শিকল ভাঙার অনুপ্রেরণা, প্রেমিকের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার সুধা। কবিতায় ছিল ভবিষ্যতের হাতছানি। কবি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’

সাহিত্যিক কিংবা কবি পরিচয় ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি সংগীতস্রষ্টা নজরুল রূপে বেশি পৌঁছেছেন। তাঁর লেখা গান ছাড়া যেন প্রেমিক হৃদয় তৃপ্ত হয় না। ভজন-কীর্তন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না পুজো। সমবেত স্বরে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ না গাইলে যেন ঈদের আমেজ অনুভূত হয় না। তাঁর মতো আর কেউ পারেনি বাংলা গানে এত সুর ও শব্দের বৈচিত্র্য তুলে ধরতে। নজরুলের লেখা গানে ছিল দ্রোহের সংলাপ, কখনও বেজেছে কাওয়ালীর সুর। তিনি শুধু বাংলা গানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেননি, করেছেন শব্দ ভান্ডারও। সুরের সঙ্গে শব্দের মিলন, উপমার প্রয়োগসহ আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা ব্যবহারের যথার্থতায় নজরুল। তিনি গান লিখেছেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, চিত্তানন্দে মত্ত হয়ে। কখনও লিখেছেন প্রেমে পড়ে, আবার কখনও অর্থসংকটে পড়ে। আর্থিক সংকট দূর করতে গান নিয়ে ছুটে গেছেন রেকর্ডিং স্টুডিওতে, চলচ্চিত্র প্রযোজকদের দ্বারে। নানা সভায় আনন্দে মেতে গেয়েছেন নিজের লেখা গান। 

বিশ শতকের প্রথম ভাগে যে পঞ্চরত্ন বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পড়াশোনা শুরু গ্রামের মক্তব থেকে। কিন্তু আট বছর বয়সে পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনে নেমে পড়েন। যোগ দেন আঞ্চলিক লেটো দল বা নাটুয়া দলের সঙ্গে। যে দলের কাজ ছিল সর্বসাধারণের জন্য লোকগান ও নাটক পরিবেশন করা। এই দলের জন্য গান লিখতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় বাংলার লোক সংস্কৃতি, পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে। যার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর রচিত গানে। লেটো দলের সঙ্গে কাজ করা অবস্থায় নজরুল বেশ কিছু পালাগান রচনা করেন, যার মধ্যে বানর রাজকুমারের সং, রাজা হরিশ্চন্দ্র, সিন্ধু বধ, মেঘনাদবধ, কুশ ও লব, কংস বধ, দেবযানী-শর্মিষ্ঠা, দাতা কর্ণ উল্লেখযোগ্য। পৌরাণিক ছাড়াও লেটো দলের জন্য নজরুল ব্যঙ্গাত্মক, ইসলামি, দ্বৈত, সামাজিক পালাও রচনা করেন, যা সেই সময়ে ‘দুখুমিয়ার লেটোগান’ নামে জনপ্রিয় ছিল। লেটো দলের সঙ্গে আট-নয় বছর বয়সে যোগদান করলেও লেখা শুরু করেন ১২-১৩ বছর বয়স থেকে। সেই সময় থেকেই তার গানে মিশ্র ভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। 

নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। একদিন দেয়ালে সাঁটানো বিজ্ঞাপন দেখে মনস্থির করলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফৌজে যোগ দিবেন। কিছুদিন পর যোগদান করলেন। তবে যুদ্ধে কতটুকু সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তার তথ্য জানা যায়নি। জানা গিয়েছিল করাচিতে পোস্টিংয়ের পর নজরুল একজন মৌলভীর কাছে ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। শুধু ভাষাচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বিখ্যাত সব ফার্সি কাব্য পড়েও শেষ করেছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁর গানে ও কাব্যে ফার্সি শব্দের মনোরম ব্যবহার করেন তিনি। গানের সুরেও এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত। কিছু গানে ব্যবহৃত জিপসি সুর যোগ করেছে ভিন্ন ধরনের আবেশ। তাঁর ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণিবায়, জলতরঙ্গে ঝিল্‌মিল্‌ ঝিল্‌মিল্‌ ঢেউ তুলে সে যায়’ গানে রয়েছে আরবি সুর। আবার কিউবান সুরে তিনি বেঁধেছেন ‘দূর দ্বীপ-বাসিনী, চিনি তোমারে চিনি। দারুচিনির দেশের তুমি বিদেশিনী গো, সুমন্দভাষিণী’ গানটি।

নজরুল ছিলেন সুর স্রষ্টা। তিনি ১৮টি নতুন রাগের সৃষ্টি করেছিলেন। সেগুলোর ওপর গান তৈরি করে রাগগুলোকে জীবন্ত করে গিয়েছেন। যার মধ্যে তিনটি পর্যায়ে মোট ১৭টি গান কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে, ‘উদাসী ভৈরব’ গীতিনাট্যের সঙ্গে ৬টি গান প্রচারিত হয়েছিল। এরপর কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘নব রাগ মালিকা’র দুটি অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় ১১টি রাগ। যার মধ্যে ছয়টি রাগ পরিবেশিত হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি প্রচারিত প্রথম অনুষ্ঠানে। ১১ মে নব রাগমালিকার দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল পাঁচটি রাগ। 

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানের শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম ভক্তিমূলক গান। ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের নানা দিক নিয়ে অজস্র ভক্তিমূলক গান রচনা করেছেন তিনি। নজরুল ইসলামি সংগীতে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। একসময় বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী গানের কথা শুনলে মুখ ফিরিয়ে নিত। কিন্তু তারাই নজরুলের রচিত গান ‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি এবং নাম মুহাম্মদ বোল রে মন, নাম আহমদ বোল’ শুনে তন্ময় হলো। ইসলামিসংগীত ছাড়াও তিনি রচনা করেছিলেন শ্যামাসংগীত। সাধক ও কবি রাম প্রসাদের পর একমাত্র কাজী নজরুলই অজস্র শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। তাঁর রচিত শ্যামাসংগীতের সংখ্যা ২৪৭টি। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ-কাঠিতে’Ñ এই গানগুলো প্রতিনিয়ত বেজে চলে মন্দিরে মন্দিরে। এই ভক্তিমূলক গানগুলোই যেন পুজোর প্রাণ। তিনি ছিলেন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক মানুষ। নয়তো নিজ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বাইরে গিয়ে অন্য ধর্মের দেবী আরাধনায় এত ভক্তি ফুটিয়ে তোলা ছিল অসাধ্য। তাঁর রচিত শ্যামাসংগীতের সুরারোপ তিনি নিজেই করতেন। 

বাংলা সংগীতে অভুতপূর্ব ঘটনা নজরুল ও সংগীতজ্ঞ আব্বাসউদ্দীনের মেলবন্ধন। কাজী নজরুল ইসলামের ৫০টির অধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। দুজনার সম্মিলনে বাঙালি হৃদয়ে নবজাগরণের জোয়ার আসে। আব্বাসউদ্দীন কোচবিহারে পড়তে এলে এক সভায় নজরুলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেদিন নজরুলের উৎসাহে সভায় আব্বাসউদ্দীন রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন, যা মুগ্ধ করেছিল নজরুলকে। তিনি আব্বাসউদ্দীনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, একদিন তুমি অনেক বড় গায়ক হবে। আব্বাসউদ্দীন কলকাতায় এলে নজরুলই তাঁকে গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে নিয়ে যান গান রেকর্ডের জন্য। নজরুলের অনুপ্রেরণায় আব্বাসউদ্দীন শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। তিনিও কবিকে ইসলামী গজল, কবিতা লেখায় অনুপ্রেরণা দিতেন। একদিন আব্বাসউদ্দীন নজরুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উর্দুতে যে ধরনের কাওয়ালি, গজল ও ইসলামি গান গাওয়া হয়, তা বাংলায় গাওয়া যায় কি না। তাঁর উৎসাহে নজরুল অসংখ্য গজল ও কাওয়ালি রচনা করেন। 

সাহিত্যিকের মানসিক অবস্থা ও জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তাঁর সাহিত্যকর্মে। নজরুলের ক্ষেত্রে কথাটি যেন শতভাগ সত্যি। তাঁর লেখা গান, কবিতাসহ নানা সাহিত্যকর্মে সময় ও জীবনের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি যখন প্রেমে পড়েছেন তখন লিখেছেন, ‘আলগা করো গো খোপার বাঁধন, দিল ওয়াহি মেরা ফাঁস গায়ি’। বিরহ বিকেলে তিনি লিখেছেন, ‘শাওনো রাতে যদি, স্মরণে আসে মোরে’। ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশের দায়ে জেলে গিয়ে বিদ্রোহের গান লিখেছেন, কারার ঐ লোহ কপাট। তার দ্বিতীয় পুত্রের মৃত্যুর শোকে লিখলেন, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’। প্রায় সব অবস্থায় গান লেখার অসাধারণ প্রতিভা ছিল কবি নজরুলের। পাঁচ মিনিট থেকে শুরু করে ৩০ মিনিটের মধ্যে সুরসহ তৈরি করে ফেলতেন সম্পূর্ণ একটি গান। তিনি যেন গানে মিশে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতেন সুর, তাল ও লয়ে। হৃদয় উজাড় করে লিখতেন মনের কথাগুলো। প্রেম, দ্রোহ, ভালোবাসা ও গানে নজরুল চিরন্তন। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা