তন্ময় রহমান
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩ ১৩:১৬ পিএম
আপডেট : ২৪ মে ২০২৩ ১৩:১৭ পিএম
ময়মনসিংহের ত্রিশালের বিচুতিয়া বেপারিবাড়ি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র
কবি নজরুল ইসলামের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির ধারক ময়মনসিংহের ত্রিশাল। নির্জন ও কোলাহলমুক্ত চিরসবুজের অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত এই এলাকা। চারদিক ঘন খালে বেষ্টিত। রাস্তার পাশে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া আর জারুল ফুল। এমনই মনোমুগ্ধকর এই জায়গাটি আরও নান্দনিক হয়ে উঠেছে একজন বিখ্যাত কবির পদচারণায়। তিনি আর কেউ নন, আমাদেরই চিরচেনা কাজী নজরুল।
বাংলা সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভার অধিকারী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার বাল্যবিজড়িত ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার কাজীর শিমলা গ্রামের রফিজউল্লাহ দারোগাবাড়ি আর বিচুতিয়া বেপারিবাড়ি। এই দুই জায়গাতেই কেটেছে কবির শৈশব ও কৈশোর। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র।
১৯১৪ সালের প্রথম দিকে বর্ধমানের আসানসোলের রুটির দোকানে কাজ করার সময় কবিকে নিয়ে আসা হয় ত্রিশালে। বর্তমানে কবির স্মৃতিকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা বিচুতিয়া বেপারিবাড়িতেই কবি জায়গির থাকতেন। সেখান থেকেই কবি দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ও পড়াশোনা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ্য করেছি ত্রিশালে কবি নজরুলের প্রভাব। যেদিকেই তাকানো হবে, সেদিকেই রয়েছে কবির নামে স্থাপিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত বিচুতিয়া বেপারিবাড়ি। যেখানে গড়ে উঠেছে কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। অদম্য বাংলাদেশ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট থেকে কবির স্মৃতিকেন্দ্রে ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত হলো। ২১ মে ২০২৩ বিকালে মোমেন, নাঈম, লাকাদ, যুথী, রাতুল, হাবিবসহ বেশ কয়েকজন অদম্য ক্যাম্পাস থেকে রওনা দিলাম কবির স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্দেশে।
কিছুদূর সামনে যেতে আমাদের সামনে পড়ল বহুল পরিচিত বটতলা। শোনা যায় কবি নজরুল স্কুল পালিয়ে এই বটতলায় বসে বাঁশি বাজাতেন। অদম্য রাতুল বলে উঠল, ত্রিশাল যেন এক নজরুল-তীর্থ। যেদিকেই তাকাই শুধু নজরুলময়তা। কিছুক্ষণ বটতলায় বসে আমরা সবাই ভাবনার জগতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। বটতলা থেকে উঠে হাঁটা শুরু করলাম স্মৃতিকেন্দ্রের মূল ভবনের দিকে। পায়ে হাঁটার তালে তালে অদম্য যুথী কবিতা আবৃত্তি শুরু করল- ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির/ শির নিহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির…।’
৫-৭ মিনিট হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নজরুলের বেড়ে ওঠা সেই পরিবার এখন অবহেলিত। কবির নামে ত্রিশালে বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি স্কুল থাকলেও বিচুতিয়া বেপারির বংশধররা বর্তমানে অবহেলায়-অনাদরে আছেন। তাদের খবর নেওয়ার যেন কেউ নেই। শুধু নজরুলের জন্মবার্ষিকী এলে কেউ কেউ তাদের ডাকেন, খোঁজখবর নেন। সরকারিভাবে তাদের জন্য ভাতা ব্যবস্থার কথা বলা হলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
নজরুলকে পালিত বিচুতিয়া বেপারির বংশধর আবুল কাশেম জানান, আমাদের পূর্বপুরুষরা নজরুলকে লালনপালন করেছিলেন। কবির স্মৃতিরক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আমরা আবাদি জমি দিয়েছি। কিন্তু আমরা সবদিক থেকে অবহেলিত।
অতঃপর আমরা প্রবেশ করলাম সেই স্মৃতিকেন্দ্রের ভেতর। বেশ রোমাঞ্চকর কিছু মুহূর্তের সৃষ্টি হলো। কেমন যেন একটা সাহিত্যভাবের উদয় হলো মনের মধ্যে। এই কেন্দ্রের দোতলার একটি অংশে আছে পাঠাগার। অন্য একটি কক্ষে নজরুলের কিছু ছবি ও নিজ হাতে লেখা গানের খাতা। এসব স্মৃতি ফ্রেমবন্দি করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেয়ালে।
আরও কিছুদূর সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম কবির ব্যবহৃত একটি গ্রামোফোন। সংরক্ষিত আছে কবির হাতের উর্দু লেখা, ব্যবহৃত ইলেকট্রিক এল্পি রেকর্ডার। যা দেখে আমরা বেশি অবাক হয়েছি তা হলো স্ত্রী ও পুত্রদের সঙ্গে কবির একটি ছবি। পাশের পুরনো টেবিলে রয়েছে কবির অসমাপ্ত কিছু গানের একটি খাতা। তার ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিসপত্রের মাঝে আমরা কবিকে খুঁজে পেয়েছিলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এলে আমরা পুনরায় ক্যাম্পাসে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু মন যেন ফিরে যেতে চাচ্ছিল না।
কবি যে ঘরটিতে থাকতেন সেই কুঁড়েঘর আজ আর নেই। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই স্থানে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি ঘর। তবে বর্তমানে ঘরটি রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। ফ্লোর পাকা থাকলেও উইপোকা মাটি তুলে বাসা বেঁধেছে। যেখানে নেই কোনো কার্যক্রম। ত্রিশালের বিচুতিয়া বেপারিবাড়ি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে কবির স্মৃতির ধারক ও বাহক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কবিকে জানবে ও বুঝবে এই স্মৃতিকেন্দ্রের মাধ্যমে। এই স্থানটি শুধুমাত্র নজরুল গবেষকই নয়, সাধারণ মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান নজরুল গবেষক, শিল্পীরা এবং দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ এই কেন্দ্রটি ভ্রমণে এসে বেশকিছু গাছের চারা রোপণ করেছেন। পাশাপাশি প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে। তাই কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্মৃতিকেন্দ্রের সঠিক মূল্যায়ন প্রয়োজন।