আনিয়া তাসকিন
প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৩ ১৩:৪৪ পিএম
অলংকরণ : জয়ন্ত সরকার
ধরায় জ্যৈষ্ঠের পদার্পণ হলো মাত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্রের মতো তার আগমনে আনন্দিত গ্রামবাংলা। হাতভর্তি তার মিষ্টি ফলের সুগন্ধি ও বাহারি ঝুড়ি। সঙ্গে সোনালি রোদের বর্ষণ। গ্রামীণ আবহাওয়ায় সে নিয়ে এলো অপূর্ব এক উৎসব। শিশু-কিশোরদের ফল কুড়ানোর ছোটাছুটি, পুকুর-নদীতে দাপিয়ে বেড়ানো। তাদের আনন্দধারার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় গ্রীষ্মকালীন ছুটি। সবকিছু মিলিয়ে জ্যৈষ্ঠ যেন এক মধুমাখা মাস।
বাংলায় বিভিন্ন ধরনের ফল পাকতে শুরু করে জ্যৈষ্ঠের আগমনের সঙ্গেই। চৈত্রে মুকুলের জন্ম, বৈশাখ মাস শৈশবকাল আর জ্যৈষ্ঠতে হয় পরিণত। রসে ভরপুর বিভিন্ন ফলের সমারোহ গ্রামীণ জনপদে গরমের তিক্ততার তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়। এক বিশাল ফলের উৎসব চলে মাসজুড়ে। পাকা ফলের সুগন্ধে মিষ্টি পরিবেশ বিরাজ করে বাংলার ঘরে ঘরে।
এ সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে বহুবিচিত্র আমের মেলা। প্রায় ৫৮ জাতের আমের আসর বসে। আমের গায়ে যেমন পাকা রঙ, ব্যবসায়ীদের মুখে সে রঙের ছটা। বাজারে আমের মধ্যে পাওয়া যায় ফজলি, ল্যাংরা, হিমসাগর, মোহনভোগ, আম্রপালি, বালুসার, গোপলা গুটি ইত্যাদি। এ ছাড়াও অন্যান্য ফলের মধ্যে কাঁঠাল, জাম, জামরুল, লিচু, আতা, আনারস, তরমুজসহ নানা ফল। যার মাধ্যমে তৈরি হয় বিভিন্ন স্বাদের আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি।
শুধু ফল নয়, জ্যৈষ্ঠ মাসে ধানক্ষেত পরিণত হয় সোনালি কার্পেটে। বাংলাদেশের নিচু এলাকার বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে আমনের বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। অথবা ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে আমনের চারা রোপণ করে। বোরো ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে কৃষকরা ধান সংগ্রহ করে শুকিয়ে নেয়। পরে শুকানো বীজ মাটির কলসিতে, টিনের বোয়াম বা ড্রামে সংরক্ষণ করা হয়।
তা ছাড়া এ মাসে পাটচাষিরা জমিতে সেচ দিতে থাকে। সঙ্গে করা হয় আগাছা পরিষ্কার। অতিরিক্ত চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে খাওয়া হয়, যা অতি সুস্বাদু। জ্যৈষ্ঠ মাসে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ করতে দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে। গ্রীষ্মকালীন ডাঁটা, বরবটি, ঢেঁড়স, বেগুনসহ নানা ধরনের সবজি ফলে দেশজুড়ে।
এতসব সতেজ শাকসবজি আর ফলমূল পেতে শহরবাসী ছুটে যায় নিজ গ্রামে। শিশু-কিশোরদের মাঝে যেন আনন্দের বন্যা। গ্রামীণ শিশুদের সঙ্গে তারাও আম কুড়াতে মেতে ওঠে। তাই বুঝি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেনÑ “বন্ধু, আজো মনে পড়ে/ আম কুড়ানোর খেলা/ আম কুড়াতে যাইতাম দু’জন/ নিশির ভোরের বেলা।”
তবে শিল্প-সাহিত্য অনুযায়ী গবেষকরা জ্যৈষ্ঠকে মধুমাস বলতে নারাজ। তাদের কাছে কনিষ্ঠ চৈত্রই নাকি মধুমাস। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চৈত্র মধুর, তবে সুমধুর নয়। তিনি লিখলেন- “প্রহর শেষের আলোর রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
বাংলা অভিধানেও মধুমাস শব্দের অর্থ চৈত্র মাস। অভিধানমতে, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে বসন্তকাল। মধু বলতে বসন্তকালকে বোঝায় কবিতায়। চণ্ডীদাস চৈত্র মাস অর্থে মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করে বলেছিলেন, ‘মধুমাস আপায় মাধব পরশে।’ কেশব চন্দ্র কুণ্ডু লিখেছিলেন, ‘ধরার সহাসহাসে মধুভরা মধুমাসে উষার গগনে পাখি নবদিবাকর, জগৎ আনন্দময় যেন সুখ সমোদয় নয় কিরে নয় পাখী নয় মনোহর?’
কবিতায় যে মধুভরা সময়ের কথা বলা হয়েছে তা একসময় নিঃসন্দেহে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের চৈত্র শুধু খরা আর খাঁ খাঁ রৌদ্রে পরিপূর্ণ। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতু পরিবর্তন ধারায়ও এসেছে নতুনত্ব। বছরের জ্যৈষ্ঠ মাসে যেখানে মিষ্টি মধুর পরিবেশ, চৈত্র সেখানে শুকনো। তাই স্বাভাবিকভাবেই মধুমাসের খেতাবটুকু জ্যৈষ্ঠ পেয়ে যায় প্রকৃতির কাছে। কৃষ্ণচূড়া, জারুল আর সোনালু তাকে সাজিয়ে দিয়ে বলেÑ তোমায় দিলাম আজ মধুমাস নাম।