মালেক খান
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৩ ১৬:৫১ পিএম
পরিবারের সবার সঙ্গে অন্তিকের নিয়মিত খাওয়া হলেও বাবার সঙ্গে খাবার টেবিলে দেখা হয় না। তার বাবা রজত মিয়া একজন দারোয়ান। চাকরি করেন বড়লোকের এক বাড়িতে। বাড়ির মালিকের নাম সুজন কুমার। তিনি পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। নিরীহ, নির্যাতিত, অবহেলিত বাঙালিদের পক্ষে সব সময় কথা বলেন। এসব কথা বাবার মুখে অনেকবার শুনেছে অন্তিক।
আজ সোমবার, খাবার টেবিলে সবাই এক সঙ্গে বসেছে। পরিবারের ছোট ছেলে বিজয়। আজ সে বাবাকে পেয়ে খুব খুশি। সুযোগ পেলেই বাবা তাকে গল্প ও গান শোনান। সব সময় তার পকেটে ছোট ছেলে বিজয়ের একটা ছবি রাখেন।
হঠাৎ করে বাবা বললেন, বৃহস্পতিবার আমরা দূরে কোথাও ঘুরতে যাব। বিজয় বলে উঠল- আমরা বড় মামার বাড়ি শাহবাজপুর গ্রামে যাব। মামাতো ভাইবোন রবিন ও সুমি তার প্রিয় বন্ধু। বিজয়ের কথা শুনে বাবা রাজি হলেন।
অন্তিকের মা তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে মালিক দু-তিনদিনের ছুটি দেবে? আর ছেলেরা বাইনা ধরেছে নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে হবে। দেশে পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়, কীভাবে কি করবে? রজত বলল, এসব নিয়ে চিন্তা করো না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মালিক বড্ড ভালো মানুষ, তাকে বুঝিয়ে বললে সম্মতি দেবেন।
অন্তিক তার নানাজানের কাছে চিঠি লিখল। প্রিয় নানাভাই, আমরা ২৬ মার্চ তোমাদের বাড়িতে আসব। নানুভাইকে বলে দিও পিঠা তৈরি করে রাখতে। তার হাতের তৈরি পিঠা আমার খুব পছন্দ। তোমাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে বিশেষ একটা পুরস্কার আছে।
রজত বাবু কাজের ফাঁকে ছেলেদের জন্য জামাকাপড় কিনে রাখলেন। বাড়ির মালিক থেকে তিন দিনের ছুটি ও কিছু টাকা অগ্রিম চেয়ে নিলেন। কিন্তু মালিকের কড়া শর্ত, ২৫ তারিখ রাত পর্যন্ত পাহারা দিয়ে তারপর যাওয়া যাবে।
২৫ মার্চ, দিনটি ছিল বুধবার। পরিবারের সবাই সন্ধ্যা থেকে জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত। অন্তিক ও বিজয় নানাবাড়িতে কী কী করবে, সেই পরিকল্পনা চলছিল। তারা বাবার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল। সন্ধ্যা পার হয়ে মধ্যরাত চলে এলো; কিন্তু বাবা আর এলেন না।
এক পর্যায়ে অন্তিক মাকে বলল, বাবা কি আমাদের ঘুরতে যাওয়ায় কথা ভুলে গেল? আমরা কি নানাবাড়িতে যাব না? মা ছেলের মাথায় হাত রেখে কি যেন চিন্তা করতে লাগলেন। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে অন্তিক তার বাবার খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার। এই রাতেই দু-তিনজন লোক অন্তিকের লাশ নিয়ে এলো বাড়িতে। একজনকে বলতে শোনা গেল, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অন্তিককে গুলি করে হত্যা করেছে। সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই চারদিকে হৈচৈ আরও বেড়ে গেল। পাকিস্তানি নরপিশাচরা নাকি বাঙালি দমনে গণহত্যায় মেতেছে।
হঠাৎ কেউ একজন বিজয়কে বলল, তোমার বাবার মতো দেখতে একজনকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। মৃতদেহের পকেটে একটি ছবি পাওয়া গিয়েছে। বিজয় ছবিটি হাতে নিয়ে দেখল এটা তারই ছবি। যা তার বাবা ভালোবেসে সব সময় নিজের কাছে রাখতেন।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হলো। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু বাবা আর ভাইকে নিয়ে গ্রামে যাওয়া হলো না বিজয়ের।