একাত্তরের দিনগুলি
রেজাউল আলম
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৩ ১৩:১৬ পিএম
রুমির সাথে ক’দিন ধরে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। ও যদি অন্য ছেলেদের মতো বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে রেখে বাবা-মাকে লুকিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যেত, তাহলে একদিক দিয়ে বেঁচে যেতাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমি তাকে শিখিয়েছি লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করবে না। এখন নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। রুমি আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রুমি সদ্য আইএসসি পাস করা ছাত্র। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে। পাশাপাশি আমেরিকার একটা ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যাডমিশন হয়েছে। এ বছরের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে এভাবেই রুমি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তার ছেলে রুমি না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যায় না কেন? তা নিয়ে আক্ষেপের যেন শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় সপরিবারে ঢাকাতেই থাকতেন তিনি। স্বামী শরীফ ইমাম, বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমি, ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামী। এ ছাড়াও সংসারে ছিলেন বৃদ্ধ শ্বশুর।
তাদের বড় ছেলে রুমি গেরিলা বাহিনীর সদস্য। আগরতলার মেলাঘর থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে রুমি, শাহাদাত, আলম, চুল্লু, আজম, বদি, জুয়েল, চিন্নু, স্বপন, কাজী, আজাদ, সেলিম, হ্যারিস, মুক্তার, জিয়া, আনু, ওয়াহিদ, চিংকু, ডা. আখতার আহমদ, ডা. নাজিম, ড. জাফুরুল্লাহ্, ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, লে. কমান্ডার এটিএম হায়দারসহ সবাই ঢাকায় অবস্থান করছিল। গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে বাসায় এসে রুমি মাকে বলেছিলÑ ‘জানো মা মণি, আমাদের সেক্টর কমান্ডার কি বলে! তিনি বলেন, কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না, চায় রক্তস্নাত শহীদ। অতএব আমরা সবাই শহীদ হব। এই কথা ভেবেই মনকে তৈরি করেই এসেছি।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে ঢাকার তাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা গেরিলাদের আঁতুড়ঘর। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, টাকা-পয়সা, চিকিৎসাসহ সব সহযোগিতা এই বাড়ি থেকে করা হতো। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রাত বারোটার দিকে রুমিকে পাক বাহিনীরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সঙ্গে রুমির বাবা শরীফ ইমামসহ ছোট ভাই জামীকে। ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝে গিয়েছিল পাকবাহিনীরা তাকে ছাড়বে না। তাই বাবা ও ছোট ভাইকে শিখিয়ে দিল স্বীকারোক্তি দেওয়ার সময় কি বলতে হবে। তারা যেন বলে, আমরা কিছু জানি না। এরপর বাবা শরীফ ইমাম ও ছোট ভাই জামীকে নির্যাতন শেষে ছেড়ে দিলেও রুমি আর বাড়ি ফেরেনি। পাকবাহিনীর নির্যাতন শেষে ফিরে আসার কিছুদিন পর মৃত্যু হয় শরীফ ইমামের। আশ্রয় নেওয়া হতাহত মানুষের জনস্রোতে পরিণত হচ্ছিল তাদের বাড়িটা। বুকে পাথর বেঁধে সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন শহীদ জননী। মায়েদের সেবা, ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়।
১৯৭১ সালের তৎকালীন সময়ের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত তুলে ধরা হয়েছে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলাদের কালজয়ী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শহীদ জননী জাহানার ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা নগরীর চিত্র বর্ণনার মাধ্যমে দেশব্যাপী ভয়াবহ চিত্রের জাল বিস্তারের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ক্রোধ, ক্ষোভ ও গেরিলা মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে শিহরণ জাগানো ভাষায় বর্ণনা করে মুক্তিযুদ্ধকে পৌঁছে দিয়েছেন পাঠক হৃদয়ে।