× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

তোয়াব ভাই : আমাদের শেষ পারানির কড়ি

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২২ ১৯:১১ পিএম

আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২২ ২২:৫১ পিএম

তোয়াব খান। ফাইল ছবি

তোয়াব খান। ফাইল ছবি

তোয়াব ভাই চলে গেলেন।
তখনও আকাশে শরতের সাদা মেঘ ভাসছে, রোদের ঢেউয়ে ঝকঝকে চারপাশ; এমন দিনের মধ্যাহ্নে মৃত্যু আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল তাঁকে। বিদায় নিলেন আমাদের ‘সাংবাদিকতার শেষ পারানির কড়ি’। অবসান ঘটল মহাকালের এক মহাপর্বের। কে জানে, হয়তো তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিল ইতিহাসের এমন অনেক মহাসত্য, যা শেষ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল কেবল তাঁরই স্মৃতিজগতে।

বর্ণাঢ্য, রীতিমতো বর্ণাঢ্যই তো তাঁর দীর্ঘ জীবন; কত রোগ-শোক স্পর্শ করেছে তাঁকে, স্পর্শ করেছে জীবদ্দশাতেই প্রিয় এক কন্যাকে হারানোর শোক; স্পর্শ করেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের উত্তাপ; কিন্তু তিনি নীরব, অনড় এক শালপ্রাংশু, সব ঝড়ঝাপটা আর প্রখর রোদের তাপ গ্রহণ করে, উপেক্ষা করে নিজের কাজটি করে গেছেন গভীর একাগ্রতায়। মনে হয়, তাঁর জীবনের প্রতিজ্ঞাই ছিল এই, ‘সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা/ যেন আমার গানের শেষে থামতে পারি শমে এসে-/ ছয়টি ঋতুর ফুলে ফলে ভরতে পারি ডালা’। ৮৭ বছর বয়সে পৌঁছেছিলেন, তাঁর স্মৃতিতে ছিল দেশভাগ, ছিল মুক্তিযুদ্ধ, ছিল মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর দেশের নানা ঘাতপ্রতিঘাতের প্রতিচ্ছবি। দেশভাগ হলো, তাঁর বাবা ডাক্তার আবদুল ওয়াহাব খানের আবাস হাকিমপুর পড়ল সীমান্তের ওপারে-এপারে পড়ল মা জোবেদা খানমের পিতৃভূমি রসুলপুর। সেখানেই কাটল তাঁর শৈশব, কৈশোর। মাত্র ষাট টাকা বেতনে ১৯৫৫ সালে দৈনিক সংবাদে শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক বা এপ্রেনটিস সাব-এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ‘সীমান্ত সীল করা হয়েছে’ ব্যানার হেডিং দিয়ে দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশের পরদিন তোয়াব ভাই নিজেই সেই ‘সিল’ করা সীমান্তপথে পাড়ি জমান ভারতে। তাঁর কণ্ঠে আমরা নিয়মিত শুনি ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তারপর ক্রমান্বয়ে তিনি ইতিহাসের এমন সব কালপর্বের মধ্য দিয়ে গেছেন, তা যদি তিনি লিখে রেখে গিয়ে থাকেন, তা হলে আমাদের নিশ্চয়ই নতুন নতুন অনেক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে, চমকে উঠতে হবে। 

সদ্যস্বাধীন দেশে তোয়াব ভাই সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দৈনিক বাংলার। আর ১৯৭৩ সালে সেখানেই ঘটেছিল সেই সাড়াজাগানো ঘটনা,-ভিয়েতনামে মার্কিনি হামলার প্রতিবাদে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করল, সে মিছিলে গুলি চালানো হলে ছাত্রহত্যার ঘটনা ঘটল আর চটজলদি রাজপথে জনতার হাতে চলে এলো দৈনিক বাংলার টেলিগ্রাম সংখ্যা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওএসডি হতে হয় দৈনিক বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব ভাইকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তির ১০ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন তোয়াব ভাই। পরিণতি যা-ই অপেক্ষা করুক না কেন, এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় সাংবাদিকের প্রকৃত দায়িত্ব পালন থেকে তিনি কখনও সরে আসেননি। অনেক পরে ২০০১ সালেও আমরা দেখেছি, রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় তাঁকে চটজলদি দৈনিক জনকণ্ঠের টেলিগ্রাম সংখ্যা বের করতে। মনে আছে, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ‘গণভবন’ হস্তান্তরের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেটি নিয়ে কেউই কিছু লিখছিলেন না, বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন আশ্চর্যরকম নীরব। জনকণ্ঠের ‘চতুরঙ্গ’ পাতার দায়িত্বে তখন ছিলেন সাংবাদিক আতাউর রহমান ভাই। তোয়াব ভাই তাঁর মাধ্যমে বদরুদ্দীন উমরকে অনুরোধ করলেন বিষয়টি নিয়ে কলাম লিখতে। কলামটি ছাপা হওয়ার পর আলোচনার ঝড় উঠল। বাতিল হলো গণভবন হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত। 

১৯৭৩ সালে ওএসডি হয়ে পদত্যাগ করার পর তোয়াব ভাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর করে পাঠানো হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমানকে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে দেখা দেয় নতুন পরিস্থিতি। ১৯৭৭ সালে তোয়াব ভাই প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) পরিচালক ও পরে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হন। এরপর তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান তথ্য কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর জেনারেল এইচএম এরশাদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে প্রেস সচিব নিযুক্ত করেন তোয়াব ভাইকে। এরশাদ পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গেও নির্দিষ্টকালের জন্য দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এমন সব ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কালের নীরব এক সাক্ষী। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁকে বলতেন, ‘সাংবাদিকতার শেষ পারানির কড়ি’-কথাটি সর্বৈবই সত্যি।

আমরা যারা একদা দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করেছি, তাদের এবং আরও অনেকের কাছে তোয়াব খান কেবলই ‘তোয়াব ভাই’-অসীম এক নির্ভরতার স্থান। শুনেছি, বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের অনেকে তাঁকে বলতেন, ‘আমাদের সাদা মানিক’। পারিবারিক পরিসরে তিনি সবার কাছে পরিচিত ‘রাঙা’ নামে। যে নামেই পরিচিত হোক না কেন, তাঁর কাজের স্থানটি ছিল শুধুই সাংবাদিকতাকে ঘিরে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করার পর তিনি আবারও ফিরে গিয়েছিলেন দৈনিক বাংলা সম্পাদনার দায়িত্বে। কিন্তু মাত্র ১০ মাসের মতো কাজ করতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর আপসহীনতার সঙ্গে সংঘাত দেখা দেয় সরকারের; খালেদা জিয়ার সরকার পদচ্যুত করে তাঁকে। তারপর তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হন দৈনিক জনকণ্ঠে-যা ওই দৈনিকটিকে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য এক উচ্চতায়। রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না, অথচ বঙ্গবন্ধু থেকে এইচএম এরশাদের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালনের সুবাদে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের একেবারে কেন্দ্রেই ছিল তাঁর অবস্থান। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন করেছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও প্রতিনিয়ত সেই চেতনাকে শানিত করে তুলেছেন তিনি। তারুণ্যে সাংবাদিকদের প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনেরও তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী যখন ‘সাংবাদিক প্রকাশনা অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করেছিল, তখন যে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তোয়াব ভাই ছিলেন সে আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ; ছিলেন অল পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের (পিএফইউজে) ফেডারেল এক্সিকিউটিভ কমিটির (এফইসি) সদস্য। দিনের পর দিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হাতেকলমে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন তিনি, তাই পেরেছেন নিরাসক্ত এক সাংবাদিক হয়ে উঠতে। তিনি কখন কোন পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন, কোন পদে যুক্ত ছিলেন, সেটি এখন আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়-গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি হয়ে উঠেছেন নিজেই এক প্রতিষ্ঠান।

আমার মতো এমন অসংখ্য জনকে পাওয়া যাবে, যাদের পরম সৌভাগ্য, তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তীক্ষ্ম অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছিল তাঁর। নিজের মধ্যে কোনো ফাঁকি নিয়ে ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়ালে ধরা পড়ে যেতে হতো, আবার সততার সঙ্গে নিজের অক্ষমতার জানান দিলে ওই দৃষ্টিই হয়ে উঠত পরম এক ভরসার জায়গা। 

তোয়াব ভাইয়ের সামনে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিশুসাহিত্যিক এখ্লাসউদ্দিন আহ্‌মদ ভাই, তিনিও এখন প্রয়াত। কত স্মৃতি তাঁদের ঘিরে! আর এখন তোয়াব ভাই চলে যাওয়ার সংবাদ শুনবার পর থেকে কোনো স্মৃতিই যেন সরানো যাচ্ছে না। গণভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনের সময় তোয়াব ভাইয়ের সহকর্মী ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কুলের একজন মণি ভাই- যুগ্ম সচিব (পরবর্তী সময়ে সচিব) মনোয়ারুল ইসলাম; বঙ্গবন্ধুর দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তার একজন ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাত বছর ধরে কাজ করে জনকণ্ঠ ছেড়ে আসার কয়েক মাস আগের একটি ঘটনা। তোয়াব ভাই লিফটে উঠছেন দেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি হাতের ইশারায় ডেকে নিলেন। লিফটের মধ্যে তাঁর সামনে আমি ঘামতে লাগলাম। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘তুমি মণি ভাইয়ের ভাই?’ আমি অবাক ও থতমত খেয়ে গেলাম; এই কথা তো কারও জানবার কথা নয়, আমরা তো আপন ভাইয়ের গল্পও বলতে গেলে করি না। তবু মাথাটা একটু হ্যাঁ-এর মতো করে নড়ে উঠল আমার। আর তিনি তাঁর সেই তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী চোখে তাকিয়েই থাকলেন, ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোণে হালকা এক টুকরো স্নেহমাখা হাসি ফুটে উঠল। 

এখন তোয়াব ভাই কত দূর আকাশের তারা! তবু মনে হয়, তিনি আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আছেন সেই অন্তর্ভেদী চোখ আর স্নেহমাখা হাসি নিয়ে। আমরা এই ‘সত্যবাক’কে কখনও ভুলব না, এদেশের ইতিহাসও পারবে না ভুলতে।

প্রবা/আরকে 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা